ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ওডারল্যান্ড : বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত একমাত্র বিদেশি

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫২, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওডারল্যান্ড : বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত একমাত্র বিদেশি

শাহেদ হোসেন : এ দেশের সঙ্গে কোনোকালেই তার নাড়ির বন্ধন ছিল না। তবে এ দেশের মাটি-পানি আর মানুষকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। আর পাঁচজন বিদেশির মতোই চাকরি করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এসেছিলেন তিনি। ২৫ মার্চ পাক হানাদারদের তাণ্ডবের পর অনেকেই নিজেদের দূতাবাসের সহযোগিতায় স্বদেশে ফিরে গেছেন। যারা ছিলেন তারা বিষয়টিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় ভেবে দূরে সরে থেকেছেন। তবে ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে বাটা সু কোম্পানির ম্যানেজার ডব্লিউ.এ.এস. ওডারল্যান্ড ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতায় বিচলিত হয়ে ওডারল্যান্ড নিজের সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। এমন সাহসী ভূমিকা এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে একাত্মতার জন্য এই বিদেশিকে দেওয়া হয়েছে বীরপ্রতীক খেতাব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত বিদেশি।

 

মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাটা সু কোম্পানিতে যোগ দেন ওডারল্যান্ড। এর কয়েক বছর পরেই বাজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। জার্মানি যখন হল্যান্ড আক্রমণ করে তখন হল্যান্ডের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন ওডারল্যান্ড। মাত্র পাঁচদিনের মাথায় নাৎসিদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস)। পরাজিত সৈনিক হিসেবে ওডারল্যান্ডকে নিয়ে যাওয়া হয় বন্দিশিবিরে। কৌশলে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধফেরত সৈনিকদের ক্যাম্পে কাজ করতে থাকেন। যোগ দেন ডাচ-প্রতিরোধ আন্দোলনে।

 

ওডারল্যান্ড এক চিঠিতে লিখেছেন, 'নাৎসি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমি আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতায় যুক্ত হই। জার্মান এবং বিভিন্ন ডাচ উপভাষায় আমি অনর্গল কথা বলতে পারতাম। এই সময় জার্মান হাই কমান্ডের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ফলে ডাচ আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতাকে আমি সাহায্য করতে পেরেছিলাম।’

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর ওডারল্যান্ড বাটা সু কোম্পানিতে তার পুরনো কাজে ফিরে আসেন। এরপর চার বছর তিনি সিঙ্গাপুরে বাটার কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা হন। ১৯৭০ সালের আগস্টে বাটার প্রোডাকশন ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়ে ওডারল্যান্ড ঢাকা আসেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পান। ওই সময় বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক হন তিনি।

 

২৫ মার্চ পাকবাহিনীর তাণ্ডব দেখে ওডারল্যান্ডের হৃদয়ে ভেসে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই বিভিষীকাময় স্মৃতি। তিনি মুক্তিপাগল, অসহায় বাঙালির পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। কর্মসূত্রে ওডারল্যান্ডের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বাটা সু কোম্পানির পার্সেনাল ম্যানেজার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নেওয়াজের। সেই সূত্র ধরে তিনি কর্নেল নেওয়াজকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। এভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার গড়ে ওঠে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। কিছুদিন পর ঢাকায় আসেন কর্নেল নেওয়াজ এবং তাকে নিয়ে যান ঢাকা সেনানিবাসে। সেনা হেড কোয়ার্টারে তাকে বিবেচনা করা হয় সম্মানিত মেহমান হিসেবে। এই সূত্র ধরেই সেনাসদরের দরজা ওডারল্যান্ডের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। এর বেশ কিছুদিন পর কর্নেল নেওয়াজের মাধ্যমে তার সাথে জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল নিয়াজী ও পুলিশ কমিশনার চৌধুরীসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন সামরিক ও বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তাদের পরিচয় ঘটে। এ কারণেই যুদ্ধের সময় পাক সেনাবাহিনীর গুরত্বপূর্ণ তথ্যগুলো সহজেই তিনি পেয়ে যান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তা কাজে লাগান।

 

একাত্তরের পঁচিশে মার্চের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পর তিনি কৌশলে কিছু পাস সংগ্রহ করেন। যেমন সান্ধ্য আইন পাস। ইচ্ছেমতো সেনাসদরে যাতায়াতের পাস।  এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে তিনি শত্রুর অনেক গোপন তথ্য বের করে আনতে সক্ষম হন। যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন বাটার পার্সেনাল ম্যানেজার এ.কে.এম আব্দুল হাই। এছাড়া বাটার কর্মকর্তা আব্দুল সালাম, হুমায়ুন কবির খান, নূরুল ইসলাম, ডা. হাফিজুল ইসলাম ভুঁইয়া (কুসুম ডা.) ও আইসিডিআরবির কর্মকর্তা মার্কিন নাগরিক ট্রাকার প্রমুখকে নিয়ে তিনি একটি দল গড়ে তোলেন। এদের মধ্যে আব্দুস সালাম ও হুমায়ুন কবির খানকে তিনি গেরিলা ট্রেনিং নেওয়ার জন্য আগরতলা পাঠান।

 

ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধকালীন মুহূর্তে ওডারল্যান্ড পাক রণকৌশল ও পদ্ধতি সম্পর্কিত যাবতীয় প্রাপ্ত তথ্য নিয়মিত পাঠিয়ে দিতেন ২ নম্বর সেক্টরের মেজর এ টি এম হায়দার এবং জেড ফোর্সের মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে। নিজের নিরাপত্তার জন্য রক্ষিত ব্যক্তিগত পিস্তলটিও বুলেটসহ দিয়ে দেন মেজর এ টি এম হায়দারকে। টঙ্গীর বাটা কারখানার ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ওডারল্যান্ড গড়ে তুলেছেন প্রশিক্ষণ শিবির। কমান্ডো হিসেবে অস্ত্র, গোলাবারুদ সম্পর্কে তার পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল। নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা যুদ্ধেও অংশ নেন।

 

১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন ওডারল্যান্ড। এরপর তিনি অস্ট্রেলিয়া চলে যান। বাংলাদেশের এই বিদেশি বন্ধু আমৃত্যু নামের শেষে বীরপ্রতীকের সংক্ষিপ্ত রূপ ‘বি.পি’ লিখেছেন। ২০০১ সালের ১৮ মে পার্থের একটি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ওডারল্যান্ড।

 

তথ্যসূত্র :

বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড : মাহবুবুর রহমান বাবু

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধু :  আ শ  ম বাবর আলী

মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড : সম্পাদনা মুনতাসীর মামুন

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়