ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

এভাবেই শেকল ভাঙুক তবে

ম্যারিনা নাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০০, ২৯ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১২:২৮, ২৯ আগস্ট ২০২০
এভাবেই শেকল ভাঙুক তবে

ক’দিন ধরে একটি খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে- বাইক চালিয়ে কনের শোভাযাত্রা। ঘটনাটি ঘটেছে আমার জেলাশহর যশোরে। এদেশে বাইক, গাড়ি-ঘোড়া, নৌকায় বরযাত্রা খুবই সাধারণ ঘটনা। ইদানিং হেলিকপ্টারে চড়েও বিয়ে করতে যাচ্ছেন অনেকে। এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা কারো খুব একটা মাথাব্যথা দেখা যায় না। কিন্তু বাইকে চড়ে গায়ে হলুদে কনের শোভাযাত্রার বিষয়টি ভাইরাল হয়েছে; বলা চলে এ যেন এক তুলকালাম কাণ্ড!

কিন্তু কেন? একজন নারী মোটরবাইক চালিয়ে শো-ডাউন করেছে বলে? নাকি বরের আসনে বর নয়, কনে ছিল বলে এই সমালোচনা? আমার মনে হয়, মূল কারণ হলো এটিই- বাইকে বর নয়, কনে ছিল। বরযাত্রীর বদলে ছিল কনেযাত্রীর বহর। এদেশের মানুষ এই দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত নয়। তারা বরাবরই দেখে এসেছে বা রূপকথার গল্পে শুনেছে- বর ঢাল তলোয়ার নিয়ে বীরের বেশে ঘোড়ায় চড়ে টগবগ করে ছুটে আসবে, আর গা ভর্তি গহনাসমেত মাথা নত করে থাকা সলাজ বধূকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাবে। অর্থাৎ বর আসবে বিয়ে করতে কনের বাড়ি। কনে বিয়ে করতে যাবে না। কিন্তু এই অনুষ্ঠান ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তুমুল আলোচনা-সমালোচনায় মেয়েটির প্রতি যেমন অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল, তেমনি অনেকে ছি ছি, জাত গেল, ধর্ম গেল রব তুলেছেন। অনেকে আবার মেয়েদের মোটরবাইক চালানোর বিষয়টিকেই মুখ্য ইস্যু করে সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ মেয়েটিকে ‘জাহান্নামী’ বলেও মন্তব্য করছেন।

এখানে আমার জিজ্ঞাস্য- মেয়েরা কি আজ নতুন বাইক চালাচ্ছে? কিছুদিন আগে ভারতের ব্যাঙ্গালুরে গিয়েছিলাম; দেখে এসেছি সেখানে মেয়েদের নব্বই শতাংশ বাইক বা স্কুটি চালায়। বোরখা, হিজাব পরা মেয়েদেরও দেখেছি স্মার্টলি বাইক চালাতে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিলাম। আমাদের দেশেও অনেক বছর হলো মেয়েরা স্কুটি, বাইক চালাচ্ছে। যদিও নারী বাইকারদের প্রতি অনেক পুরুষের মনোভাব; এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেনো ‘চিড়িয়াখানার জীব’ দেখছে! ফারহানা নামের এই মেয়েটি দেড় বছর অফিসে যাতায়াত করেছে বাইক চালিয়ে। গ্রামগঞ্জে মেয়েরা এখন অনেকে সাইকেলে চেপে স্কুলে যাচ্ছে। বহু আগে থেকেই উড়োজাহাজ চালাচ্ছে মেয়েরা। নারী দেশ চালাচ্ছে, সংসদে যাচ্ছে, অফিস চালাচ্ছে- তবুও কেন এই হুজ্জোত! আমার মনে হয়, সমস্যা অন্যখানে। সমস্যা হলো, ফারহানা নিজে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করতে চেয়েছেন। অনুষ্ঠানে বন্ধুদের নিয়ে বাইক চালিয়ে শহরের রাস্তায় শোভাযাত্রা করেছেন। এই বিষয়টিকেই অনেকে মানতে পারছেন না। তারা বিষয়টিকে নারীর স্পর্ধা হিসেবে দেখছেন, অশ্লীলতা হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। একেই বলে কূপমণ্ডকতা! যুগে যুগে এভাবে নারীদের নানা বেড়াজালে আটকে দেওয়া হয়েছে। সেই কবে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন বলে গিয়েছেন- ‘উড়তে শেখার আগেই পিঞ্জরাবদ্ধ এই নারীদের ডানা কেটে দেওয়া হয় এবং তারপর সামাজিক রীতিনীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তাঁদের।’ 

যে অধিকার, যে স্বাধীনতা নারীদের মানুষ হিসেবেই স্বাভাবিকভাবে পাওয়ার কথা ছিল, সেই স্বাধীনতা, সেই অধিকার আন্দোলন করে, নানা বাধা অতিক্রম করে আদায় করে নিতে হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। নারী মা, নারী কন্যা, নারী বোন, নারী স্ত্রী এসব সম্পর্কের বাইরে নারীকে মানুষ ভাবতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নেই আমাদের সমাজে। এমনকি নারী নিজেও নিজেকে মানুষ ভাবতে সাহস করে না। যে কারণে পরিবারে পুরুষ অসুস্থ হলে নারী হয় সেবাদাসী। কিন্তু পরিবারের গৃহকর্তী যখন শয্যাশায়ী হন, তখন তিনি কুণ্ঠিত, বিব্রত হয়ে প্রাণপণে অসুখ এমনভাবে লুকিয়ে রাখেন যেন তার জন্য অসুস্থ হওয়াটাই লজ্জার।

আজও পর্যন্ত বাইরে গিয়ে উপার্জন করার স্বাধীনতা বা অনুমতি সব পরিবারের নারীদের নেই। আবার যেসব পরিবারে রয়েছে সেখানেও অনেকে আগে ভাবেন, কোন পেশায় গেলে মেয়েটি বা বউটি সংসার এবং চাকরি একসঙ্গে সামলাতে পারবে। সন্তান, সংসারের প্রয়োজনে নারীকেই আগে আয়ের রাস্তা রুদ্ধ করে বাড়িতে বসে থাকতে হয়। এখানেও কখনও নারীর নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য থাকে না।

তবে দিন বদলাচ্ছে। ধীরে হলেও নারীরা নিজের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে, সামাজিক নিয়ম নামের শেকল ভাঙছে। যতদূর জানা যায়, ফারহানার বিয়ে হয়েছে তিন বছর আগে। কাবিন হলেও বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বাকি ছিল। ইতোমধ্যে তিনি মা হয়েছেন। কিন্তু নানা কারণে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়নি। এই আফসোস তাঁর মনে থেকেই গিয়েছিল। এবার সন্তান জন্ম নেওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির সবাই যখন যশোর যান তখন তিনি বিয়ের অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নেন। এ জন্য তিনি যে উপায় গ্রহণ করেছেন সেটি আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে অভিনব, নন্দিত বা নিন্দিত।

তবে আমি নিন্দার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি না। বরং আমি দেখতে পাচ্ছি, আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ সব জায়গায় পরিবর্তন এসেছে। একসময় যেখানে মেয়েরা নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা পছন্দের বিষয়টি জানাতে সাহস বা সুযোগ পেতো না, এখন সে তা সীমিত আকারে হলেও আদায় করে নিতে পারছে। নিজের অধিকারের কথা বলতে পারছে। ফারাহানা সেটি করে দেখিয়েছে।

মানুষের জীবনে স্বাধীনতা আসলে কী? আমার দৃষ্টিতে স্বাধীনতা হলো, নিজের ওপর নিজের সম্পূর্ণ অধিকার। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারে আইনত সমান হক। আমার শরীর, আমার ইচ্ছে, আমার পছন্দ-অপছন্দ  সব কিছুর মালিক আমি। আমার সুস্থ স্বাভাবিক মত আমি যেন নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারি। সুস্থ মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে পারি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বলতেই এই স্বাধীনতাটুকু তার প্রাপ্য। সে নারী হোক, অথবা পুরুষ। মূলকথা নারী বা পুরুষ কেউ কারো অধিকারে থাকতে পারে না। কিন্তু বস্তুত নারীকে আজো পুরুষের অধীনে বা অধিকারে থাকতে হচ্ছে।

যে কথা বলছিলাম, ফারহানার বিষয়টির প্রতি নেতিবাচক মন্তব্যগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে আমি ইতিবাচক বিষয়গুলো নিয়েই ভাবতে চাই। ঘটনাটি আমার কাছে বড় একটি সবুজ বাতির মতো। কারণ ফারহানা সাহস করেছে, এবং সে তার শখ বা ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছে। তাহলে এ কথা অন্তত বলা যায়, আমাদের পারিবারিক বা সামাজিক মানসিকতা ধীরে ধীরে হলেও বদলাচ্ছে।

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফারহানাকে নিয়ে যত মানুষ সমালোচনা করেছেন, তার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বাহবা দিয়েছেন। কয়েক বছর আগেও এই রেশিওটা হয়তো উল্টো হতো। এভাবেই একটু একটু করে ভেঙে যাক  সমাজের মরচে ধরা সব শেকল। পরিবারের আদরের ছেলেটির মতো মেয়েটিরও এসব ছোটখাটো শখ পূরণ হোক।

লেখক: প্রভাষক, কথাসাহিত্যিক

* বাংলার গতিময় কনে

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়