ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

হ‌ুমায়ূন আহমেদের প্রেমের ইউটোপিয়া

সাখাওয়াত টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ১৩ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৪:৫৬, ১৩ নভেম্বর ২০২০
হ‌ুমায়ূন আহমেদের প্রেমের ইউটোপিয়া

বাংলাভাষার অনন্য কাহিনিকার হ‌ুমায়ূন আহমেদ। কেন অনন্য? গল্পের সাবলীল বয়ান, অচানক পরিস্থিতিকে বাস্তবতায় আনা আর অবাস্তবকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলায় তাঁর দক্ষতা অতুলনীয়। বাংলা কথাসাহিত্যের সত্যিকারের একজন সৃষ্টিশীল কাহিনি নির্মাতা তিনি। ভাষার কারিকুরি তাঁর গল্পে বিশেষ নাই; তবে নির্মেদ আর সহজ, টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে। কারণ তাঁর গল্পের পাত্রপাত্রী প্রয়োজনীয় পরিস্থিতির বাইরে বিশেষ কথা বলেন না। পরিস্থিতির কারণে অপরাপর চরিত্রগুলো এসে হাজির হন। স্মৃতি যদি বিস্মৃত না হয়, তাহলে আমার বিবেচনায় তাঁর সবচেয়ে আলোচিত ও পঠিত গল্পের নাম ‘রুপা’। গল্পের কাহিনি ১৪ ঘণ্টার টানটান ঘটনা। অথচ বলেছেন ২ ঘণ্টায়। মাঝখানে ট্রেন এলো আর গেলো। গল্পের নির্মাণ কৌশল পরখ করা যাক, এবার।

‘ভাই, আপনি কি একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনতে চান?’ আচমকা এমন প্রশ্নে গল্পের শুরু! গল্প শোনার পরিস্থিতি আছে কি নাই, সেটা এখানে বিবেচ্য নয়। একদম চেনা কিংবা অচেনাও কোনো ব্যাপার নয়। এমনকি, অচেনা লোক হলে তো সন্দেহের উদ্রেক করবে, সেটাও অবিবেচ্য! গল্পের শুরুতে বোঝা যায়, কেউই কারো পূর্ব পরিচিত নন। সান্ধ্যকালীন একটি রেল স্টেশনে দু’জন মানুষ। একজন যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন। আরেকজন ট্রেন যাত্রী, যিনি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। এদের একজন গল্পের নায়ক, যিনি ট্রেনের যাত্রী, নিজের গল্প নিজেই শোনাতে চান। আরেকজন যিনি গল্পের শ্রোতা কিংবা লেখক নিজেই। এমন পরিস্থিতিতে গল্পের নায়ক অচেনা হলে শ্রোতা অবাক বিস্ময়ে কিংবা সৌজন্যমূলকভাবে নায়কের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন! কিন্তু ঘটনা অন্যখানে।

গল্প শুরুর আগে কিছু ভণিতাও আছে। নায়কের গল্প শোনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শ্রোতা অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। প্রথম কারণ, অচেনা লোকের গল্প শোনার প্রস্তাবে শ্রোতা খানিকটা অবাক! যেন এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। দ্বিতীয় কারণ, শ্রোতার মনে ‘ইন্টারেস্টিং’ শব্দটা দাগ কাটে। সন্দেহ হয়, যারা নিজেই নিজের গল্পকে ‘ইন্টারেস্টিং’ বলেন, সাধারণত সেটা হয় না। যদিও দু’জনের লক্ষ্য ট্রেন, গল্প শোনা নয়। পরস্পর পরস্পরকে জিজ্ঞেস করেন, কেন রেল স্টেশনে এলেন? এমন কুশল বিনিময়ের ভেতর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। কিন্তু নায়ক গল্প শুরু করেন পান খাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে। শ্রোতা কিন্তু পান খান না। তবে রসিকতা করেন পান নিয়ে। বলেন, ‘একটা খেয়ে দেখুন মিষ্টি পান। খারাপ লাগবে না।’ শ্রোতার প্রশ্ন, ‘আপনি কি বিশেষ দিনে গল্পের সঙ্গে-সঙ্গে সবাইকে পানও খাওয়ান?’

এই পান দিয়ে যেন গল্প বলবার পরিস্থিতি তৈরি হলো! গল্প বলবার এই কৌশল অভিনব নয়। বাংলার গায়ের উঠানে গল্পের আসরে পান খাওয়াকেই মনে করিয়ে দেয় এটা। তবে শহরে সংস্কৃতিতে এটা অভিনব বলা চলে! তারপর নায়ক গল্প বলতে শুরু করেন। কৌশলের দিক থেকে হ‌ুমায়ূন গল্পের পাঠককে সরল পথ দেখান না। কিন্তু বলার সরলতার ভেতর কূট ঘটনাকে কূট না রেখে এক হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। যা পাঠকে সহজে মোহাবিষ্ট করে। যেমন গল্পের শুরুতে তিনি বলেন, ‘ভদ্রলোক বুদ্ধিমান হলে আমার চুপ করে থাকার অর্থ বুঝতে পারবেন। বুদ্ধিমান না হলে এই গল্প আমায় শুনতেই হবে।’ আসলেই পরিস্থিতি যদি তেমন হতো, তাহলে আর গল্প বলার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু ‘পান’ গল্প বলাটাকে স্বাভাবিক করে তুলল। একজন নিখাঁদ কাহিনিকার ছাড়া এমন গল্প ফাঁদা সত্যি অসম্ভব!

নায়ক পদার্থবিজ্ঞান পড়ুয়া এক ছাত্র। দেখতে বেশ সুন্দর আর সুঠাম। মেয়েদের সঙ্গে সে কখনো আগবাড়িয়ে কথা বলেনি। কারণ সে তোতলা। মার্বেল চুষে, হোমিওপ্যাথি আর হুজুরের পানি পড়া খেয়ে ভালো হয়নি। যদিও বিয়ের পর তাঁর তোতলামো বন্ধ হয়ে যায়! একদিন নায়কের সাবসিডিয়ারি ক্লাসে এক সুন্দরী মেয়েকে দেখে কাবু অবস্থা। অবস্থা এমন, ‘প্রেমে না পড়লে আমার সেই সময়কার মানসিকতা আপনাকে বোঝাতে পারব না। আমি প্রথম দিন মেয়েটিকে দেখেই পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সারারাত ঘুম হলো না। প্রচণ্ড পানি পিপাসায় একটু পরপর গলা শুকিয়ে যায়। পানি খাই আর মহসিন হলের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করি।’

এমন অবস্থায় মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দেবে, সেই সাহসও নাই। যেহেতু সাবসিডিয়ারি সাবজেক্টের ছাত্রী, সেহেতু কোন ডিপার্টমেন্টের জানার উপায় নেই! সপ্তাহে দু’দিনের ক্লাস যেহেতু, মেয়েটি কখনো ক্লাসে আসে, আবার কখনো আসে না। মাঝে মাঝে ছেলেটি প্রেমের জ্বরে কাবু হয়ে যায়। ভীরুতার কারণে দেখা হওয়া আর না-হওয়ার ভেতর দু’বছর কেটে যায়। পরে নায়ক একটা উপায় খুঁজে নেন। অসীম সাহস করে মেয়েটির ড্রাইভারের কাছে ঠিকানা চেয়ে নেন। তারপর গল্পের উত্তেজনা শুরু হয়। সেটি কেমন?

নায়ক মেয়েটিকে চিঠি লেখেন। চিঠি কিন্তু পোস্টে পাঠান না। চিঠির বিষয়বস্তু, তিনি তাকে বিয়ে করতে চান। তাকে রাজি হতেই হবে। যতক্ষণ না রাজি হবেন ততক্ষণ তাদের বাসার গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন! সত্যিই একদিন ড্রাইভারের দেওয়া ঠিকানা অনুসারে ওই বাড়িতে যান তিনি। দাড়োয়ানকে দিয়ে ওই চিঠি পাঠান। আর নায়ক বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন ঠায়। বাসার ভেতর থেকে মেয়েটি দাড়োয়ানকে বলেন, সে তাকে চেনেন না। ছেলেটি যেন চলে যায়! কিন্তু নায়ক সকাল ৯টা থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে! মাঝে মাঝে বাসার লোকজন উঁকি দেন। নিজেদের মধ্যে মিটিং করেন কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। দেখেন, ছেলেটি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে কাঁপছে!

এক পর্যায়ে, ছেলেটিকে মেয়ের বাবা পুলিশে দিতে চায়। কিন্তু মেয়ে বারণ করে। বাবা বেরিয়ে এসে ধমক দেন, ছেলেটিকে চলে যেতে বরেন। কিন্তু ছেলেটি নাছোড়বান্দা। রাস্তার লোক জিজ্ঞেস করেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? নায়ক বলেন, ‘আমি পাগল মানুষ। আপনারা মাথা ঘামাবেন না!’ ঘটনা জানাজানি হলে, অন্য আত্মীয়-স্বজনও ভিড় জমায় মেয়েটির বাড়িতে। নায়ক নিচে দাঁড়িয়িই থাকে। এদিকে অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে। রাত ১১টা বাজে। শেষাবধি দেখা গেল, মেয়েটি বাসা থেকে বেরিয়ে ছেলেটিকে হাত ধরে বাসার ভেতরে নিয়ে যান। বলেন, টেবিলে খাবার আছে আপনার জন্য, খান। খাবার টেবিলে বসে ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নায়ক এতক্ষণ যার জন্য ‘রামকাণ্ড’ ঘটালো, এই মেয়েটি ক্লাসের সেই মেয়ে নয়, অন্য কেউ!  

গল্পে দু’টো ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, নায়ক প্রেমের কাছে অসহায়। তার গো ধরা শেষ নাগাদ অন্য কাহিনির জন্ম দিয়েছে। এত কিছুর পরও গল্পে মেয়েটির পরিবার মানবিক আচরণ করেছে। দ্বিতীয়ত, ড্রাইভার তাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে। যা তাকে অন্য এক বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। পরিশেষে নায়ক বিয়ে করেন অন্য আরেক নারীকে! কিন্তু তিনি কখনো আপন স্ত্রীকে গল্পটি বলতে পারেননি। সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। ফলে তিনি সুযোগ পেলেই গল্পটি কাউকে না কাউকে শোনান।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘রুপা’ গল্পটি নিটোল প্রেমের মনে হলেও, এটা এক ধরনের ইউটোপিয়া সৃষ্টি করেছে। গল্পের শুরু নায়কের প্রেমাবেগে মনে হতে পারে, কোনো না কোনোভাবে নায়ক প্রেমিকাকে জয় করবেন। কিন্তু না, প্রেম তাকে অন্য বাস্তবতায় হাজির করেছে। যে বাস্তবতার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। ভুল জায়গায়, ভুল দরজায় কড়া নাড়া তাকে এক মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধায় ফেলে দেয়। যা তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ইউটোপিয়া এজন্যই, না প্রেমের পরিণতি হলো, না বিরহের সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু এমন ইউটোপিয় অবস্থা পাঠককে নতুন বাস্তবতায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন হ‌ুমায়ূন! যদিও মানুষের বাস্তব সমাজে এমন ঘটনা বিরল। যা অবাস্তব মানবিকতায় পর্যবসিত। ‘রুপা’ আদতে এক নিটোল যৌনতাহীন সংবেদনশীল আবেগের গল্প।

* ভাষা, গল্প ও হুমায়ূন আহমেদ

* হুমায়ূন ও হিউমার

* ‘অসুখী’ জাতির ‘সুখী’ হুমায়ূনের গল্প

* মিসির আলির ছায়া

* স্বপনবুড়ো, আমায় ক্ষমা কোরো

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়