ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আমি সমালোচনার জবাব দেই না: মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন  

হুমায়ূন শফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৪, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৬:০১, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
আমি সমালোচনার জবাব দেই না: মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন  

অনুবাদক, লেখক, প্রকাশক পরিচয় ছাপিয়ে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন দেশের মৌলিক রহস্য উপন্যাস  লেখক হিসেবে পাঠক মনে জায়গা করে নিয়েছেন। ‘নেমেসিস’ তার প্রথম প্রকাশিত রহস্য উপন্যাস। উপন্যাসটি মৌলিক লেখা হিসেবে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভীষণ অণুপ্রাণিত হন মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। এরপর একে একে প্রকাশ পায় চারটি সিকুয়েল- ‘কন্ট্রাক্ট', 'নেক্সাস', 'কনফেশন’ এবং ‘করাচি’। তার মৌলিক রহস্য উপন্যাসের ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ তার লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ নিয়ে কলকাতার প্রখ্যাত নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি নির্মাণ করেছেন ওয়েব সিরিজ। পাঠকপ্রিয় এই রহস্য উপন্যাস সাড়া জাগিয়েছে দর্শক মনেও। তরুণ গল্পকার হুমায়ূন শফিকের সঙ্গে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের এই কথোপকথনে উঠে এসেছে ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’সহ তার লেখালেখির বিভিন্ন বিষয়। 

হুমায়ূন শফিক: প্যানডেমিক সিচুয়েশন। চারপাশে মানুষের আহাজারি। কত মৃত্যু! তারপরও জিজ্ঞেস করছি- কেমন আছেন?

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: ভালো আছি। ভালো থাকার চেষ্টাটা আরেকটু বেশি করে করতে হচ্ছে যেহেতু দীর্ঘদিন ধরেই সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে।

হুমায়ূন শফিক: পরপর আপনার দুটি উপন্যাস নিয়ে ওয়েব সিরিজ হলো। একটি ‘কন্ট্রাক্ট’, অন্যটি ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’- আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না নিজের কাজ ওয়েবে কিংবা সিনেমায় চিত্রিত হলেই বিরাট কিছু! তবে এ দেশে যেহেতু থ্রিলার সাহিত্য ওভাবে ছিল না, আর আমিও প্রায় এক যুগ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি এই ধারাটা দাঁড় করাতে, পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে, তাই আমার দুটো থ্রিলার নিয়ে বিদেশি ওটিটি থেকে কাজ হওয়াতে আমি খুশি। খুশি এ জন্য যে, এটা থ্রিলার সাহিত্যের প্রসারে কিছুটা হলেও অবদান রাখবে।

হুমায়ূন শফিক: ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ ওয়েব সিরিজটি দেখেছেন নিশ্চয়। চারপাশে অনেক পজিটিভ রিভিউ-এর পাশাপাশি কিছু তর্কও উঠে এসেছে। প্রথমে জানতে চাই, পরিচালক সৃজিত যে চরিত্রের নাম পরিবর্তন করলেন- বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন? এ ব্যাপারে কিন্তু অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: আমি দু’বার দেখেছি। আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। পরিচালক সৃজিত মুখার্জী আমার গল্পের প্রতি শতভাগ একনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি চেষ্টা করেছেন করোনার মরামারি আর বাজেটের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভালো কিছু করার। গল্পটা যারা পড়েছে তারা জানে, এটা পর্দায় ফুটিয়ে তোলা খুবই দুরূহ কাজ। ওয়েব-সিরিজটি প্রচার হবার পরপরই দর্শকদের অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে। সবার যে ভালো লেগেছে তা নয়। কোনো কাজ সবার ভালো লাগবে এমনটা আশাও করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও সেটাই হয়েছে। অনেকের কাছে এটা যেমন দুর্দান্ত লেগেছে, আবার অনেকের কাছে সেরকমটা মনে হয়নি। এটা প্রত্যাশিতই ছিল।

তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, দর্শক বাংলা কন্টেন্ট দেখার সময় নেটফ্লিক্স-এর মান প্রত্যাশা করে। আর এই প্রজন্মের দর্শক এ রকম ধীরগতিসম্পন্ন কাজ দেখতে অভ্যস্ত নয়। আমি নিজে যখন প্রথম সিরিজটা দেখেছি তখন আমার সঙ্গে দুই তরুণ ছিল, যাদের একজন আবার ডিরেক্টর। লক্ষ্য করে দেখেছি, ওই দুই তরুণ সারাক্ষণ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে করতে সিরিজটা দেখেছে। সম্ভবত বেশিরভাগ দর্শক এমনটিই করেছেন। ফলে আমাকে আবার সিরিজটা দেখতে হয়েছে। মনে হয়, যারা মনোযোগ দিয়ে সিরিজটি দেখেছেন তাদের প্রায় বেশিরভাগের কাছে এটা ভালো লেগেছে। আর রবীন্দ্রসংগীতের এমন ব্যবহার আর কোনো সিনেমা কিংবা ওয়েবে হয়েছে কিনা আমি জানি না। আমার কাছে দারুণ লেগেছে!

হুমায়ূন শফিক: অনেকেই বলছেন, সৃজিত এ দেশের ভাষা ব্যবহারে দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন। মানে বাংলাদেশের মানুষের মুখে কলকাতার বাংলা বলিয়ে নেয়ার কোষ্ঠকাঠিন্য টাইপের কাজ- বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: আমার কাছে সেরকম মনে হয়নি। ভাষার ব্যাপারে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে আতর আলীর চরিত্রে অনিবার্ণ তো রীতিমতো চমকে দিয়েছেন। আমি এতটা আশাও করিনি। আর উচ্চারণের ব্যাপারে যেটুকু খামতি ছিল তা এক্সকিউজ করা যায়। কারণ একজন বাদে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সবাই পশ্চিমবঙ্গের।

হুমায়ূন শফিক: কলকাতার পরিচালকদের এর আগেও দেখা গেছে বাংলাদেশের কোনো চরিত্রের মুখে এমন ভাষা বসিয়ে দিয়েছেন। ভাষা বিষয়টি নিয়ে কিছু বলবেন? এটি কি কলকাতার আধিপত্যবাদের মধ্যে পড়ে না?

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: ঢালাওভাবে আধিপত্যের কথা বললে ভুল করা হবে। কেউ কেউ হয়তো এ রকম মানসিকতা থেকে করে থাকে; সবাই না। আসলে এক অঞ্চলের মানুষ আরেক অঞ্চলের ভাষায় অভিনয় করতে গেলে এমন বিপত্তি ঘটেই। এই যে আমাদের টিভি-সিনেমায় দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে, সেগুলোর বেলায় কী বলবেন? শতকরা ৯৯ জন পরিচালক আর স্ক্রিপ্টরাইটার তো আঞ্চলিক ভাষাকে রীতিমতো বলাৎকার করে! উপহাস আর ভাঁড়ামোর বিষয় বানিয়ে ছাড়ে। আমি নিজে ঢাকার আদিবাসী হিসেবে জানি, টিভিতে যে ঢাকাইয়া ভাষা দেখানো হয় সেটা একেবারেই যা তা। আর যেভাবে উপস্থাপন করা হয় সেটা শুধু অপমানজনকই নয়, গর্হিত অপরাধের মধ্যেও পড়ে। কই, এসব নিয়ে কখনও কাউকে সোচ্চার হতে দেখিনি তো? আগে নিজেদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত, পরে অন্যদের দিকে মনোযোগ দিলে ভালো হয়। নইলে ব্যাপারটা জাতিগত বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই চিহ্নিত হবে।

হুমায়ূন শফিক: আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি, উপন্যাসটি লেখার পেছনের কোনো গল্প আছে কী?

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: সব লেখার পেছনেই গল্প থাকে। রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’র পেছনেও গল্প আছে, ভাবনা আছে। সেগুলো স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়।

হুমায়ূন শফিক: নামকরণের স্বার্থকতা বলতে একটা ব্যাপার আমরা পড়েছি। আপনার এই উপন্যাসটির এরকম নামকরণের কারণ কী?

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: নামকরণের স্বার্থকতার বিষয়টি আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে স্কুলজীবন থেকেই। আমাদের বোঝানো হয়েছে, সাহিত্যের নামকরণ এভাবে করতে হয়। ওভাবে করলে হবে না। পুরো বিষয়টিই সাহিত্যবিরুদ্ধ। লেখক যেমন লেখার ব্যাপারে স্বাধীন, নামকরণের বেলায়ও স্বাধীন। তিনি কী কারণে কোন নামটি বেছে নেনেব, সেটা একান্তই তার ব্যাপার। এখানে কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া, বিশ্লেষণ আশা করা ঠিক না। আমি আমার বইয়ের নামকরণের বেলায় শুধু একটা বিষয়ই মাথায় রাখি, কোন নামটা আমার ভালো লাগছে। যেটা ভালো লাগে সেটাই আমি দেই। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা দিতে পছন্দও করি না। পাঠক যাচাই করবে নামকরণটি কেমন হয়েছে।

হুমায়ূন শফিক: থ্রিলার লেখার ক্ষেত্রে অনেককেই বলতে শুনি, এখানে ভাষা অতটা ম্যাটার করে না, গল্পটাই মূখ্য। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: এটা একেবারেই ভুল ধারণা। কারা কখন থেকে এ রকম কথা রটিয়েছে আমি জানি না। সত্যি বলতে যে কোনো লেখার বেলায়ই মুখ্য বিষয় ভাষা। ভাষা যদি ঠিক না থাকে তাহলে অসাধারণ গল্পও সাদামাটা হয়ে যাবে। পাঠক পড়তে চাইবে না। আর ভাষা যদি ভালো হয়, তাহলে সাদামাটা গল্প পড়েও পাঠক তৃপ্তি পাবে। তাই লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রথমে আমি বলবো ভাষার কথা, দ্বিতীয়ত গল্প। আরো কিছু অনুষঙ্গ আছে। সেগুলো খুব বেশি জরুরি নয়।

হুমায়ূন শফিক: যাইহোক, থ্রিলার সাহিত্য নিয়ে আপনি যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তা আগে কেউ করেনি। সেবা প্রকাশনীর কথা অবশ্য আমরা জানি, কিন্তু সেটা অন্যভাবে, মেইনস্ট্রিম থ্রিলার আপনিই বোধহয় প্রথম আনলেন এ দেশে। আপনার কোনো লেখায় হয়তো পড়েছিলাম প্রথম যখন দ্য ভিঞ্চি কোড প্রকাশ করলেন, অনেকেই হেসেছিল। সেই ঘটনা তো আমরা জেনেছি। এর বাইরে আর কোনো কিছু ফেইস করতে হয়েছে?

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: সত্যি বলতে, আমি যখন আমার প্রথম মৌলিক থ্রিলার প্রকাশ করি তখন সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল ‘বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে লেখা’ গল্পকাররাই! তাদের আচরণ, মনোভাব ছিল জঘন্য আর নিম্নমানের। প্রায় ইতরামির পর্যায়ের বলতে পারেন। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই ন্যাক্কারজনক কাজ করে গেছে। মৌলিক থ্রিলার শুনলেই তাদের গাত্রদাহ হতো। আমি অবশ্য বরাবরের মতোই এসব পরোয়া করিনি, নিজের কাজ করে গেছি। একটা সময়ের পর এর ফলও পেয়েছি। নিন্দুকের দল এখন চুপ মেরে গেছে। এ ছাড়া সিরিয়াস সাহিত্যিক তকমাধারীরাও হেয় চোখে দেখতো থ্রিলার-সাহিত্যকে। তাদের কাছে এটা কোনো সাহিত্যই না! আমি তাদের নিয়েও মাথা ঘামাইনি। আমাকে যারা চেনে, তারা জানে, আমি কখনও ফেইসবুক-ইউটিউবে সমালোচনা-ইতরামির জবাব দেই না। এসব জগতকে আমি ভার্চুয়ালই ভাবি, অ্যাকচুয়াল না। ভালো করেই জানি, এখানে ভিউখোর, অ্যাটেনশন সিকার আর উগ্রবাদী লোকজনে গিজগিজ করে। আমার কাছে এরা মোটেও গুরুত্ব পায় না।

হুমায়ূন শফিক: তরুণ থ্রিলার লেখকদের নিয়ে যদি কিছু বলেন।

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: তরুণ লেখকদের বলবো, তারা যেন লেখালেখিকে ফেইসবুক সেলিব্রিটি হওয়ার মতো কিছু না ভাবে। এটা একেবারেই নিঃসঙ্গ একটি কাজ। নিভৃতচারী হয়ে একমনে লিখে যেতে হয়।  যে কোনো লেখকের জন্য একটা কাজ অবশ্যই জরুরি- প্রচুর বই পড়া। আর কোনো কিছু লিখেই বই প্রকাশ করার পাগলামি থেকে নিজেকে বের করে আনারও দরকার আছে। এখন আবার শুরু হয়েছে, নিজের গল্পকে ওয়েব-সিনেমায়-নাটকে দেখার অদ্ভুত পাগলামি। যেন এগুলো না হলে লেখক হিসেবে জাতে ওঠা যায় না। এমন মানসিকতা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। আর লেখালেখি খুবই কঠিন কাজ। লম্বা একটা সময়ের পরে গিয়ে এর ফল পাওয়া যায়। এ জন্য থাকতে হয় অসীম ধৈর্য।  

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়