ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘এই ক্ষেত্র আমার নিজের তৈরি, সৈয়দ হক তৈরি করে দেননি’

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৮, ১৫ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১২:০২, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
‘এই ক্ষেত্র আমার নিজের তৈরি, সৈয়দ হক তৈরি করে দেননি’

আনোয়ারা সৈয়দ হক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক। শিশুসাহিত্য রচনাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। উপন্যাসে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক। সংক্ষিপ্ত এই কথোপকথনে উঠে এসেছে তাঁর লেখক জীবনের গল্প। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি স্বরলিপি।   

স্বরলিপি: ‘ভয়ঙ্কর সেই রাত’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াবহ ঘটনা উপজীব্য করে লেখা। কিন্তু এর ভাষা বুনন রসাত্মক। হাসির ভেতর দিয়ে সময়ের নৃশংসতা এভাবে বর্ণনা করার পেছনে আপনার কোন ভাবনা কাজ করেছে?

আনোয়ারা সৈয়দ হক: ‘ভয়ঙ্কর সেই রাত’ শিশু-কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন করার জন্যই লিখেছি। যেহেতু শিশু-কিশোরদের জন্য বইটি লেখা, তাদের ভাষায় বইয়ের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। বই পড়তে-পড়তে তারা হাই তুলবে এবং বিরক্ত হবে; এরকম হলে তো পড়বে না। ইতিহাসের চরম সত্য বইটিতে নানা রকম রসাত্মক উপাদানে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেসব ঘটনা উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্য দিয়ে মূল লক্ষ্য ছিল, শিশু-কিশোরদের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলা, প্রশ্নবোধক করে তোলা এবং মুক্তিযুদ্ধের যে মূল কাঠামো- স্বাধীনতার চেতনা-সংগ্রাম সম্পর্কে জানানো। আমরা যে হাজার বছর ধরে পরাধীন জাতি, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমরা যে কষ্ট করেছি এবং ‘বিহারি’ বলে একটি জাতি আমাদের দেশে এসে থেকে গেছে বহু বছর ধরে, কিন্তু কোনো দিনও তারা আমাদের আপন মনে করতে পারেনি সে সত্য সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে; যে মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো বিহারিরা সঙ্গে-সঙ্গে বিপরীত দিকে চলে গেল। এবং সেই অত্যাচারী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারাও বাঙালিদের অত্যাচার করতে লাগলো। নতুন প্রজন্মকে সম্মুখ চিনিয়ে দেওয়া যে, কত খারাপ একটা রোল প্লে করেছে বিহারিরা; এটা যেন আমাদের ছেলেমেয়েরা ভুলে না যায়। যদিও তারা এখনও আমাদের দেশেই আছে কিন্তু এতো বছর পরেও বিহারিদের মন-মানসিকতা যে খুব একটা পাল্টেছে সেটা কিন্তু আমি বলবো না। সেক্ষেত্রে প্রজন্মকে সতর্ক থাকতে হবে-এখনও।

স্বরলিপি: লেখালেখির শুরু থেকেই কি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখছেন? প্রথম লেখা প্রকাশ সম্পর্কে জানতে চাই।

আনোয়ারা সৈয়দ হক: প্রথম লেখা আমি ‘সংবাদ’র সাহিত্য পাতায় লিখেছি। ছোট বয়সেই আমার লেখা বড়দের পাতায় বেরিয়েছে ১৪ বছর বয়সে। গল্পের নাম ছিল ‘পরিবর্তন’। তারপর ১৯৫৫ সালের দিকে আমি ‘ইত্তেফাক’-এ লিখতে শুরু করি। সেখানে ছোটদের জন্য লিখি। এবং সুনাম অর্জন করি। তারপর যখন ঢাকা এলাম, আরেকটু ম্যাচিউর হলাম ছোটদের জন্য লিখলাম ‘ছানার নানাবাড়ি’ আর বড়দের জন্য লিখলাম ‘তৃষিতা’।

স্বরলিপি: আপা, আপনার নাম নিয়ে আমার জানার কৌতূহল আছে। শুরু থেকেই কি এই নামে লিখতেন?

আনোয়ারা সৈয়দ হক: একদম শুরুতে ‘আনোয়ারা বেগম চৌধুরী’ নামে লিখতাম। বিয়ের পর আমি যখন বড়দের লেখা লিখতে শুরু করি, আমার স্বামীকে বললাম, আনোয়ারা বেগম চৌধুরী এতো কমন একটা নাম যে, লেখকের নাম হিসেবে কেউ খেয়ালই করে না। সঙ্গে-সঙ্গে নাম পরিবর্তন করে রেখে দিলেন ‘আনোয়ারা সৈয়দ হক’। নাম পরিবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গে যে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে, তখন তো বুঝতে পারিনি।  সরল মনে সেই নাম গ্রহণ করেছি। পরে যখন নারী সচেতনতা এলো, উইমেন্স লিড এলো তখন তাকে একদিন বললাম- তুমি কেন আমার নাম আনোয়ারা সৈয়দ হক করে দিয়েছ? তিনি বললেন- ও তাই! আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আবার নাম পাল্টে ফেলো। 

তখন কি আর পাল্টানো যায়? এই নামে তখন অলরেডি ২৫-৩০টা বই প্রকাশ হয়ে গেছে। তবে নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত মাত্রায় সচেতন ছিলেন। কোনোদিন কোনো স্বাধীনতায় বাধা দেননি। এমনকি আমি যে তাকে ছেড়ে বছরের পর বছর এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছি, বাউন্ডুলে টাইপের জীবন যাপন করেছি। কখনো কিছু বলেননি। তিনি আপন মনে লেখাপড়া করেছেন, বাচ্চাদের দেখেছেন, ঘর সংসার করেছেন। একটা সুন্দর জীবন ছিল আমাদের; সেই জীবনটার মধ্যে বিশ্বাস ছিল সবচেয়ে বেশি আর ছিল আস্থা। হয়তো সেই জন্যেই আমরা টিকে গিয়েছি। নইলে কোথায় থাকতাম, উড়ে চলে যেতাম বা পড়ে যেতাম তার ঠিক ছিল না। জীবনের শেষে এসে মনে হয়- আমি তাঁর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিনি, তিনি আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি। আমরা কখনো কারও ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকিনি।

স্বরলিপি: প্রচলিত কথা- দুজন লেখক একসঙ্গে ঘর করতে পারেন না। আপনাদের বেলায় কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা।

আনোয়ারা সৈয়দ হক: দুজন লেখক একসঙ্গে ঘর করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। দুজন লেখক একসঙ্গে ঘর করতে পারে না, কারণ তাদের মন মানসিকতা, টেম্পারমেন্ট, ভালো-মন্দে সব কিছুতে অনেকটা চুজি। দুজন লেখকের মধ্যে ভালোবাসা এবং বিশ্বাস থাকে তাহলে মানিয়ে নেওয়া যায়। তাঁর অনেক ব্যাপারে আমি বিরক্ত হতাম, হয়তো তিনিও আমার অনেক ব্যাপারে বিরক্ত হতেন। একটা জিনিস ছিল যে, আমরা কখনো কাউকে ছোট করার চেষ্টা করিনি। তাকে যেমন আমি বড় রাখার চেষ্টা করেছি, তিনিও আমাকে বড় রাখার চেষ্টা করেছেন। মেয়ে বলে, আমি তাঁর থেকে কম লিখি বলে, বা আমি তাঁর থেকে খারাপ লিখি বলে, তিনি ‘সো-কলড’ কোনো দিনও আমাকে বলেননি। সব সময় বরং বলেছেন, তুমি বড় লেখক, গুড রাইটার, শক্তিশালী লেখক, তুমি ইচ্ছা করলে অনেক কিছু লিখতে পারবে। লেখাপড়ার ভেতরে দুজনের ধ্যান, মন এমনভাবে নিযুক্ত হয়েছিল যে, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আমরা ওভাবে চুলোচুলি করা বা হইচই করার মতো স্কোপ পাইনি। হয়তো স্কোপ পেলে ঝগড়াঝাটি করতাম। এতো কাজের প্রেসার, লেখার প্রেসার যে, ঝগড়া করার সময় পাইনি। এখন মাঝে-মাঝে মনে হয়, একটু ঝগড়াঝাটি হওয়া উচিত ছিল।

স্বরলিপি: সে সময় যদি ফিরে পেতেন?

আনোয়ারা সৈয়দ হক: তাহলে ঝগড়াঝাটি অবশ্যই করতাম। কিন্তু তিনি তো পাট চুকিয়ে চলে গেছেন। এখন আর তাকে পাই না। ছবির সামনে বসে বসে মাঝেমধ্যে ঝগড়া করি। সেই ঝগড়া তো একতরফা হয়। তিনি আগেও উত্তর দিতেন না, আমি একভাবে ঝগড়া করে যেতাম। তিনি চুপচাপ থাকতেন। তাঁর ছবির সামনে এখন কথা বলা যা, আর তিনি জীবন্ত থাকতে কথা বলা একই ছিল (মলিন হেসে)।

স্বরলিপি: নামের কারণে কি কোন বিশেষ সুবিধা বা অসুবিধায় পড়তে হয়েছে?

আনোয়ারা সৈয়দ হক: অনেকেই মনে করে যে, আমি লাফ দিয়ে গাছে উঠেছি। কিন্তু না, একেবারেই নয়। আমি অন্যান্য মেয়েদেরও বলেছি, তাদের লেখা আরও ম্যাচিউর হতে হবে, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে, ঘরে-বাইরে বিচরণ করতে হবে। চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। ‘মেয়েলী লেখা’ বলে যা বোঝানো হয়, তার মানে অভিজ্ঞতা নেই, পরিপক্কতা নেই, ভাষার কারিগড়ি নেই- এমন যেন না হয়। এই কাজটিই করে যাবার চেষ্টা করেছি। তবুও কখনও কখনও পাশে বসেই কোনো মহিলা বলে উঠেছেন- এমন লেখা আমরাও লিখতে পারি, যদি আমাদের সৈয়দ হকের মতো একজন স্বামী পাশে থাকতেন। এটা যে কত বড় ভুল কথা! তা বলার মতো না। বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকদের দপ্তরে গিয়ে গিয়ে পরিচিত হয়েছি, আলাপ করেছি, নিজের লেখা পৌঁছে দিয়েছি। ‘রোববার’, ‘বিচিত্রা’, ‘চিত্রালী’, ‘দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য পাতায় লেখা আমি নিজে পাঠিয়েছি। তারপর লেখা প্রকাশ হয়েছে। এই ক্ষেত্র আমার নিজের তৈরি, সৈয়দ তৈরি করে দেননি।

অনেক সময় সৈয়দ হক দেশে থেকেছেন, আমি বিদেশে। ২০০০ সালে বিদেশ থেকে দেশে আসি। দেখি আমাকে কেউ সেরকমভাবে চেনে না। আমি তো অনেক পরে বাংলা একাডেমি পেলাম, আমার ৭০ বছর বয়সে। অথচ সৈয়দ শামসুল হক ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি এতো প্রভাবশালী লেখক ছিলেন যে, আমি ৪০ বছরের মধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাবার তদবির করাতে পারতাম। তা আমি করিনি। তিনি মারা গেলে আমি একুশে পদক পেয়েছি। তখন তো আমার ধরাধরি করারও কেউ নেই। আমি মনে করি, আমি কষ্ট করে এসব অর্জন করেছি। এখন এসে আমি বুঝি যে, সৈয়দ হকও সেটাই চেয়েছিলেন। বাংলা একাডেমিতে সৈয়দ হক সদস্য হয়েছেন ১৯৬৫ সালে। আমি বাংলা একাডেমির সদস্য হয়েছি ২০১১ সালে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার আগে কোনো দিন এই প্রতিষ্ঠানে অর্গানাইজিং কমিটির যে সভা হতো সেখানে আমি যাইনি। সৈয়দ শামসুল হকও কখনও বলেননি।

আমার কাজের চাপ, রাশ এতো ছিল যে, তিনি হয়তো কোনোদিন বলতেও পারেননি, তুমি বাংলা একাডেমির সভ্য হও, আমরা দুজনে মিলে বাংলা একাডেমির অর্গানাইজিং কমিটিতে যাই। প্রথম যেদিন বাংলা একাডেমির অর্গানাইজিং কমিটিতে যোগ দেই, দেখি দেশ থেকে, বিদেশ থেকে কত লেখক যোগ দিয়েছেন। আমি সৈয়দ হককে বললাম, আমি তো এই অর্গানাইজিং কমিটিতে যোগ দিতে পারতাম বহু আগে। কারণ আমার তো একশো বই বেরিয়েছে। কিন্তু কোনো দিন তো জানি না যে, এই রকম ফরম নিয়ে, দুইশো টাকা জমা দিয়ে সদস্য হওয়া যায়। তুমি তো আমাকে কখনো বলো নাই! শুনে তিনি বললেন- ও বলি নাই! ভুল হয়ে গেছে। 

আমরা যখন বইমেলায় যেতাম, সৈয়দ হক বলতেন, তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে হাঁটবে না। তুমি তোমার মতো ঘুরবে। তাঁর দিকনির্দেশনা ছিল- যেন কোনোভাবেই লোকে বলতে না পারে, লেখক দম্পতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি খুবই সচেতন ছিলেন যাতে প্রভাবমুক্ত থেকে আমি আমার ক্যারিয়ার গড়তে পারি। এই হলাম আমি- আনোয়ারা সৈয়দ হক। এই নামের যা কিছু অর্জন, তা আমি নিজে করেছি।

 

/তারা/ 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়