নতুন কপিরাইট আইন : চাহিদা ও যোগানের হিসেব-নিকেশ
খান মাহবুব || রাইজিংবিডি.কম

দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে বংশপরম্পরায় সঞ্চিত সম্পদ, পুঁজির সুফল পেতেই বস্তুগত সম্পদের পাশে মেধাসম্পদ থেকে দীর্ঘসময় বিরামহীন আয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করার মনস্কামনা দেখা যায় মানুষের মাঝে। বিষয়টিকে সুসংহত ও কাঠামোবদ্ধ করতেই আইন, নীতি, বিধি প্রনয়ন ও মান্যতার তাগিদ বাড়ে। ইউরোপিয় রেঁনেসাসের মাধ্যমে মানুষ বস্তুবাদী দুনিয়াকে আরো বেশি আকড়ে ধরে। মানুষের মাঝে ইহজাগতিকা ভর করে প্রবলভাবে। এসব ঘটনাপ্রবাহ মেধাস্বত্ব তথা কপিরাইট আইনের উন্মেষ ও বিকাশে বড় প্রভাবক হিসেবে সামনে আসে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ১৮৮৩ সালের প্যারিস কনভেনশনে মেধাস্বত্ব, পেটেন্ট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, ট্রেডমার্ক, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন ইত্যাদির মাধ্যমে সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনদশায় ও দেহনাশের পরও সৃষ্টিশীল কাজের আর্থিক ও নৈতিক অধিকার প্রাপ্তির বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বিষয়টি এগিয়ে যায় ভিক্টর হুগোর নেতৃত্বে ১৮৬৬ সালের বার্ন কনভেনশনে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মার্সকাট ট্রিট্রিসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ এতে সংযুক্ত হয়। মেধাস্বত্ব নিয়ে WIPO (world Intellectual propcnty onganization) মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মেধাস্বত্ব আইনগুলোকে অনুসরণ করে এবং আন্তর্জাতিক আইন মানতে চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করে। তবে প্রতিটি দেশ নিজ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় কপিরাইট আইন রচনা করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানী আমলের কিছু আইন ও অধ্যাদেশের আলোকে মেধাস্বত্ব রক্ষণের প্রচেষ্টা চলে। পরে কপিরাইট অফিস (প্রতিষ্ঠা-১৯৬৭) পুনঃগঠন ও ২০০০ সালে কপিরাইট বিষয়ে একটি আইন প্রণীত হয় যা ২০০৫ সালে সংশোধিত হয়। এরপর থেকে পৃথিবীর পরিবর্তনগুলো দ্রুত ঘটতে থাকে। মেধাস্বত্ব হরণের জন্য অতি চালাক মেধাস্বত্ব চোর বাংলাদেশের সৃজনশীল জগত যেমন: সিনেমা, গান, সৃজনশীল বই, নাটক ইত্যাদির মেধাস্বত্বর ক্ষেত্রে এক প্রবল চৌর্য্যবৃত্তির আখড়া গড়ে তোলে। পাইরেসি জেঁকে বসে আমাদের সংগীত, সিনেমা, বইসহ সৃজনশীল জগতে। ২০০০ সালের আইন দিয়ে মেধাস্বত্ব রক্ষণ দুরহ হয়ে পড়ে। চৌর্যবিত্তে নিয়োজিতদের চতুরতা ও তার্কয্য কর্ম সৃজনশীলদের মন ভেঙে দেয়। ২০১৭ সালে নতুন ও যুগোপযোগী কপিরাইট আইন প্রনয়ণের জন্য কমিটি গঠন ও কর্ম শুরু হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় দীর্ঘসময় ক্ষেপণ করে সবপথ পাড়ি দিয়ে ২০০০ সালের কপিরাইট আইনকে রহিত করে ১৯টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে গেজেট প্রকশের মাধ্যমে আইনটি বলবৎ হয় (২০২৩ সনের ৩৪ নং আইন)।
কপিরাইট আইন দ্রুত নবায়নের প্রয়োজন পড়ে কারণ এ আইন ভঙ্গকারীরা আইনের নানান ফাঁক-ফোকর বের করতে মত্ত। আর কপিরাইট নিয়ে ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত পরিবর্তন হয়। তাই তাইওয়ান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় কপিরাইটের আইনের নবায়ন ঘটে দ্রুত। একটি আইন প্রণয়ন করতে ৫ বছর পেরিয়ে যাওয়া দুঃখজনক। সবচেয়ে বড় বেদনার বিষয় হচ্ছে এখন যে নতুন কপিরাইট আইন আমাদের হাতে তা দিয়েও সম্প্রতি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যে নতুন ধ্রুপদে আমরা দাঁড়িয়ে সেখানে এই আইনকে পুরোপুরি সময়োপযোগী বলা কঠিন।
নতুন কপিরাইট আইন ২০২৩ এর বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। কারণ ২০০০ সালের আইন নিয়ে কপিরাইট অফিসকে নানান সময়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে। তাই ভুক্তভোগীদের অবস্থা বিবেচনায় বেশ বড় পরিসরে নতুন আইনের অবতারণা।
২০২৩ সালের আইনে কপিরাইট বিষয়টিকে জনসাধরণের জন্য সহজীকরণের লক্ষ্যে অনেক নতুন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ২০০০ সালের অনেক ধারা ভেঙে বিস্তৃত ও উপধারায় বিন্যস্ত করা হয়েছে। নতুনধারা ও উপধারা যুক্ত হয়েছে। পুরোনো কিছু বিষয় বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে নৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রিলেটেড রাইটস, পাবলিক ডমেইন ইত্যাদি বিষয় সংযুক্ত হয়েছে। পূর্বের আইনে (যেমন সংগীত, নাটক ইত্যাদি) রিলেটেড রাইট্স-এর বিষয়টি উপযোগী ছিল না এবং এ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে থাকত- বিষয়টি নিরসনে রিলেটেড রাইটস এর বিষয়টি বর্তমানে অনেকটা স্বচ্ছ ও বিস্তৃত করা হয়েছে। নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। কপিরাইট অফিসকে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। পূর্বের আইনে কপিরাইট রক্ষণে আমাদের দেশে সবচেয়ে লাগসই পদ্ধতি হচ্ছে টাক্সফোর্সের মাধ্যমে মোবাইল কোট পরিচালনা। পূর্বে ট্রাক্সফোর্স পরিচালিত হতো নির্বাহী আদেশে। কার্যকর এই মাধ্যম এখন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
লোকজ্ঞান ও লোক-সংস্কৃতির অধিকার সুরক্ষা পাবে এই আইনে। লোক-সংস্কৃতির নিম্নরূপ অভিব্যক্তিসমূহ সুরক্ষা করা হবে, যথা-(ক) লোক-সংস্কৃতির মৌখিক অভিব্যক্তি; (খ) লোক-সংস্কৃতির সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তিসমূহ; (গ) লোক-সংস্কৃতির শারীরিক কসরৎ-প্রধান অভিব্যক্তিসমূহ; (ঘ) লোক-সংস্কৃতির মূর্ত অভিব্যক্তিসমূহ; (ঙ) লোকভাষা, চিহ্ন, প্রতীক ইত্যাদি; (চ) লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় অভিব্যক্তি; (ছ) সনাক্তকৃত নতুন কোন মূর্ত বা বিমূর্ত অভিব্যক্তি। প্রস্তাবিত আইনে এই বিষয়ে একটি অধ্যায় নতুন সংযোজন হয়েছে।
২০০০ সালের আইনের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে সচেতনতার অভাব। এ লক্ষ্যে কপিরাইট বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করতে প্রদত্ত আইনে নানা পদক্ষেপ আছে। যেমন:
ডিজিটাল মিডিয়ার সুযোগে ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে গান, নাটক, ইত্যাদির উপার্জনে প্রণেতাকে উপেক্ষা করা হয়। বর্তমান আইনে উল্লিখিত মাধ্যম থেকে অর্জিত আয়ে প্রণেতার অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ছাপানো হরফে প্রকাশিত যে কোনো বই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়ার উপযোগী নয়, সেগুলো ডিজিটাল টকিং বই, ব্রেইল বই, অ্যাকসেসিবল ইলেকট্রনিক টেক্সট অথবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য পাঠযোগ্য করার ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কপিরাইট আইনের এই সামান্য পরিবর্তন SDG GOAL সবার জন্য একীভূত শিক্ষা অর্জনে সহায়ক হবে। প্রতিবন্ধীদের বৃহত্তর স্বার্থে বর্তমান আইনে উল্লিখিত বিষয়টি সংশোধনের জন্য বিবেচনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে একটি নতুন উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। যে কোনো অনুমোদিত সম্প্রচার বন্ধে কপিরাইট অফিসকে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে।
কপিরাইট ভাঙ্গকারীরা যেহেতু জেনেবুঝে আইনটি সাধারণত ভঙ্গ করে অবৈধ অর্থ অর্জনের নিমিত্তে, তাই বর্তমান আইনে প্রতিটি ধারার সম্ভাব্য ফাঁক-ফোকর নিরাপদ করতে বিস্তৃত করে বলা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় বিবরণ ও ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। যেমন: কপিরাইটের সংজ্ঞার বিষয়ে শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে:
* কোনো একমাত্রিক কর্মকে অন্য মাত্রিক (দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক, চতুর্থ মাত্রিক, ইত্যাদি) কর্মে রূপান্তরসহ যে কোনো আঙ্গিকে কর্মটি পুনরুৎপাদন করা;
* কর্মটি জনগণের মধ্যে প্রচার করা;
* সার্কুলেশনে রহিয়াছে এইরূপ অনুলিপি ব্যতিরেকে, কর্মটির অনুলিপি জনগণের জন্য ইস্যু করা;
* কর্মটিকে কোনো চলচ্চিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা;
* কর্মটির অভিযোজন করা;
চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে:
* কর্মটির অংশবিশেষের প্রতিবিম্বের ফটোগ্রাফসহ ভিসিপি, ভিসিআর, ভিসিডি, ডিভিডি, ডিজিটাল বা অন্য কোনোভাবে বা মাধ্যমে উহার অনুলিপি তৈরি করা;
* ইতঃপূর্বে একইরূপ অনুলিপি বিক্রয় বা ভাড়া প্রদান করা হউক বা না হউক ভিসিপি, ভিসিআর, ভিসিডি, ডিজিটাল পদ্ধতিতে বা অন্য কোনোভাবে চলচ্চিত্রের অনুলিপি বিক্রয় বা ভাড়া প্রদান করা অথবা বিক্রয় বা ভাড়া প্রদান করিবার প্রস্তাব করা বা অনুরূপ কার্যাদির জন্য লাইসেন্স প্রদান করা কিংবা বিক্রয় বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যপূণকল্পে উহার অনুলিপি সংরক্ষণ, বহন, বাজারজাতকরণ বা জনসমক্ষে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রদর্শন করা; এবং
* চলচ্চিত্রের ভিসিপি, ভিসিআর, ভিসিডি, ডিভিডি, ভিটিআর, কেবল,স্যাটেলাইট চ্যানেল, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ডিজিটাল বা অন্য কোনো উপায়ে উহার শ্রবণযোগ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য বা অনুধাবনযোগ্য অনুলিপি জনগণের মধ্যে প্রচার ও প্রদর্শন করা;
‘তথ্য প্রযুক্তি-ভিত্তিক ডিজিটাল কর্ম’ অর্থ কোনো সুনির্দিষ্ট ফল পাইবার উদ্দেশ্যে তথ্য ও উপাও প্রক্রিয়াকরণ করিয়া এইরূপ যন্ত্র যেমন- কম্পিউটার, মোবাইল ফোন বা কোনো ডিজিটাল যন্ত্র, ইত্যাদিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুষ্ট ও ব্যবহৃত সৃজনশীল কার্য, যাহাতে উহার অন্তর্ভুক্ত তথ্য-উপাত্ত, সোর্স কোড, সারণি, চার্ট, গ্রাফ, শব্দ-ধ্বনি, চিত্র, চলমান চিত্র, নকশা, টেক্সট, নির্দেশনা, সংকেত এবং এই ধরনের কর্ম ব্যবহার করিবার নির্দেশিকা;
নতুন আইনে কপিরাইট অফিসের উল্লেখযোগ্য কার্যাবলি
* বিদেশি ভাষা হইতে বাংলা ভাষায় অনুবাদ বা পুনঃপ্রকাশের লাইসেন্স প্রদান;
* সম্প্রচার সংক্রান্ত বিদেশি কর্মের বাংলায় অনুবাদ করিবার লাইসেন্স প্রদান;
* কপিরাইট রেজিস্ট্রিকৃত কর্মের অবৈধ কপি আমদানি বন্ধকরণ;
* সাহিত্যকর্ম বা নাট্যকর্মের অনুবাদ, প্রকাশ কিংবা পুনরুৎপাদনের লাইসেন্স প্রদান;
* লোকসংস্কৃতি ও লোকজ্ঞান সংরক্ষণ;
* কপিরাইট বিষয়ে সরকারকে, সময়, পরামর্শ প্রদান;
* শৈল্লিক কার্যক্রমকে প্রণাদনা ও উৎসাহ প্রদান;
কপিরাইট রেজিস্ট্রারের কাজ সুষ্ঠুভাবে ও ন্যায়ানুগভাবে পরিচালনার জন্য নতুন আইনে বলা আছে (৩) যদি রেজিস্ট্রারের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, এই ধারার অধীন গৃহীত কার্যধারায় আদেশ প্রদানের সময় সাক্ষ্য সম্পর্কে কোনো নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উদ্ঘাটিত হইয়াছে বা উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণে কোনো ভুল রহিয়াছে, তাহা হইলে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, দাখিলকৃত আবেদনের ভিত্তিতে অথবা নিজ উদ্যোগে রেজিস্ট্রার তাহার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করিতে পারিবেন।
‘নতুন কপিরাইট আইনের সম্প্রচার সংস্থা এবং সম্পাদনাকারীর অধিকার ও মেয়াদ’ শিরোনামে নতুন অধ্যায় (ষষ্ঠ অধ্যায় যুক্ত হয়েছে), ‘লোকজ্ঞান ও লোকসংস্কৃতির অধিকার সুরক্ষা’ শিরোনামে (অষ্টম অধ্যায়) যুক্ত হয়েছে, নতুন আইনে যুগ চাহিদার বিষয় লক্ষ্য রেখে ডিজিটাল কর্মের সংজ্ঞা নিধারণ করা হয়েছে- বিষয়টি অতি প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশে কপিরাইট ব্যবস্থাপনার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে কপিরাইট সমিতি গড়ে না ওঠা। কপিরাইট সমিতি উন্নত ও উন্নয়শীল দেশে কার্যকর হলে কপিরাইট বাস্তবায়নের জনসচেতনাতার কাজটি ফলপ্রসু হয় এবং কপিরাইট সমিতি বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে দূতায়লি ও অনেক সময় শালিসদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশে এতোদিন কপিরাইট সমিতির উল্লেখযোগ্য কার্যকারিতা ছিলো না। সিঙ্গাপুরের ‘দ্যা কপিরাইট লাইসেসিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সোসাইটি লিমিটেড’ দেশের সামগ্রিক কপিরাইট ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখে, এমনকি নাইজেরিয়ার মতো দেশে ‘দ্যা রিপ্রোডাকশন রাইট্স সোসাইটি অব নাইজেরিয়া’ বিশেষ ভূমিকা রাখে। অথচ আমাদের দেশে এখনও e-Copyrigat Application System বিবিধ সমস্যার বেড়াজালে বন্দি। এসব সমস্যা মাথায় রেখেই কপিরাইট আইন-২০২৩ এ কপিরাইট সমিতি-এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় (নবম অধ্যায়) বিস্মৃতভাবে যুক্ত করা হয়েছে।
কপিরাইট ব্যবস্থাপনায় লাইসেন্স প্রদান ও গ্রহণ দীর্ঘমেয়াদী আয় অর্জন ও অংশীজনদের প্রাপ্যতাকে নিশ্চিত করে। এ জন্য নতুন আইনে লাইসেন্সের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে দশম অধ্যায় রচনা করা হয়েছে। অধ্যায়ের শুরুতেই বলা হয়েছে ‘কোনো বিদ্যমান কর্মের কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী বা কোনো ভবিষ্যৎ কর্মের কপিরাইটের সম্ভাব্য স্বত্বাধিকারী তাহার বা তাহার নিকট হইতে যথাযথভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির প্রদান করিতে পারিবে।’ (ধারা ৪৫, দশম অধ্যায়)
মেধাস্বত্ব সব সময় দেশীয় পরিমণ্ডলে ব্যাপ্তি নিয়ে বিদ্যমান থাকে না। বিষয়টি শুধু দৈশিক নয় বৈশ্বিকও বটে। এ জন্য দেশ-বিদেশে কপিরাইট রক্ষণে এবং মেধাস্বত্বর গমনাগমনে সুবিধা নিশ্চিতকল্পে ‘আন্তর্জাতিক কপিরাইট’ (অধ্যায় এয়োদশ) অধ্যায় যুক্ত করে বাংলাদেশের কপিরাইট ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিকে সুশৃঙ্খল ও কাঠামোবদ্ধ করা হয়েছে।
আইন, আইনের উৎপত্তি ও বিকাশ মানুষকে নিরুপদ্রপ সমাজের সন্ধান দেয়। তাই সমাজের বাঁক বদলে ও মানুষের গতি ও গন্তব্যের পরিবর্তনে আইন পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধনের খোলসে আবর্তিত হতে হয়। আইনের বিস্তৃতি ও ব্যাখ্যা সরল হলে সুবিধা ভোগকারীদের জন্য সুফল বৃদ্ধি ঘটে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই কপিরাইট আইনের শেষার্ধ্বে (উনবিংশ অধ্যায়) বিবিধ নামীয় একটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। এখানে কপিরাইট রেজিস্ট্রার ও কপিরাইট বোর্ডকে দেওয়ানি আদালতের ন্যায় নিম্নোক্ত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে-
* সমন প্রদান এবং কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং তাহাকে শপথপূর্বক পরীক্ষা;
* কোনো দলিল প্রদর্শন এবং উপস্থাপন;
* হলফনামাসহ সাক্ষ্য গ্রহণ;
* সাক্ষ্য বা দলিল পরীক্ষার জন্য কমিশন মঞ্জুর;
* কোনো আদালত বা কার্যালয় হইতে কোনো সরকারি নথি বা উহার অনুলিপি তলব;
* বিরোধ নিম্পত্তির লক্ষ্যে মধ্যস্থতা;
* যৌক্তিক প্রয়োজনে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ; এবং
* বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য যে কোনো বিষয়
ধারা ১২১ রেজিস্ট্রার বা বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ প্রদানের আদেশ ডিক্রির ন্যায় কার্যকর হইবে। রেজিস্ট্রার বা বোর্ড কর্তৃক এই আইনের অধীন প্রদত্ত অর্থ প্রদানের প্রত্যেক আদেশ বা বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত অনুরূপ আদেশের বিরুদ্ধে আনীত আপিলে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ, রেজিস্ট্রার, বোর্ড বা, ক্ষেত্রমত, সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্ট্রার কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেট দেওয়ানি আদালতের ডিক্রি মর্মে গণ্য হইবে এবং অনুরূপ আদালতের ডিক্রির ন্যায় অভিন্ন পদ্ধতিতে কার্যকর যোগ্য হইবে।
অবৈধ সম্প্রচার বন্ধে কপিরাইট রেজিস্ট্রারের ক্ষমতা : কোনো কর্মের অবৈধ সম্প্রচার সম্পর্কে কোনো কপিরাইট বা সম্পৃক্ত অধিকারের স্বত্বাধিকারীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রেজিস্ট্রার সম্প্রচারসংশ্লিষ্ট আইন প্রযোগকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হইলে উক্ত কর্তৃপক্ষ অবিলম্ব, উক্তরূপ অবৈধ সম্প্রচার বন্ধ করিবার ব্যবস্থা করিবেন।
আইনের মধ্যে শক্তি, প্রতিকার ও নিবারণমূলক ব্যবস্থা থাকে। কিছু আইনের ভীত মানুষের মানবিকতা, চেতনা ও বিবেককে জাগ্রত করার প্রতি বিশেষ নজর থাকে। মানুষের সচেতনতার মাধ্যমে কিছু আইনে মান্যতা সম্প্রসারণের তাগিদ থাকে। কপিরাইটের মতো আইন তখনি সমাজে অধিক ক্রিয়াশীল হবে যখন সমাজের Ethical Code of Conduct শক্তিশালী হবে। এই আইন Dust Stick Action এর মাধ্যমে ফলপ্রসু করতে চাইলে সুখকর অভিজ্ঞতা নাও হতে পারে।
নতুন কপিরাইট বিলম্বে প্রণীত হলেও এটা আনন্দ সংবাদ। কিন্তু এই আইনের জন্য কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়ে আছে। কারণ গত ৪-৫ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নানান ধ্রুপদ হয়তো নতুন আইনে কিছু অংশ কভার করবে না। কপিরাইট আইন ২০২৩ এর সমস্যাগুলো সনাক্ত করা যাবে কিছুদিন অতিবাহিত হলে। কারণ কার্যক্ষেত্রে নতুন সমস্যা ও সংকট হাজির হবে তখনি আইনের বাস্তবসম্মত যথাপোযুক্ততা প্রকাশ পাবে। এখন এই আইন সুসংহত করতে আইনের আলোকে একটি প্রবিধান প্রণয়ন দ্রুত করা গেলে কার্যক্ষেত্রে কপিরাইট আইনের কার্যকারিতা বাড়বে।
তবে সব কিছুর পর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে কপিরাইট সংশ্লিষ্টদের মনোভুবনের পণ- ‘আমরা কপিরাইটকে মান্য ও শ্রদ্ধা করি, নিজ ও অন্যের জন্য সমধিক’। সামাজিক সচেতনতা আগের চেয়েও বেশি জোরদার প্রয়োজন। ২০০০ সালে প্রণীত আইন রদ করে ২০২৩ এর নতুন আইন কার্যকর হলো কিন্তু ২০০০ সালের আইন রক্ষায় কপিরাইট অফিস যে শ্লোগান সামনে রেখে এগিয়েছে সেই বিষয়টি শুধু প্রচারে নয় বিবেক ভূমিতে প্রোথিত করতে হবে। ‘পাইরেসিকে না বলি’ এটাই সব আইনের মহৌষধ।
লেখক: সদস্য, কপিরাইট আইন প্রনয়ন ২০২৩ টেকনিক্যাল কমিটি
তারা//
আরো পড়ুন