ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘জনপ্রিয় হতে চেয়েছি বলেই প্রচুর প্রেমের গল্প লিখেছি’ 

মুজাহিদ বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪০, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৬:৫৪, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
‘জনপ্রিয় হতে চেয়েছি বলেই প্রচুর প্রেমের গল্প লিখেছি’ 

ইমদাদুল হক মিলন কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় দুইশ। নূরজাহান, অধিবাস, পরাধীনতা, কালাকাল, বাঁকাজল, নিরন্নের কাল, কালোঘোড়া, কেমন আছ সবুজপাতা তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্য। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ইমদাদুল হক মিলনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদ বিল্লাহ

আপনার লেখক হওয়ার গল্পটি জানতে চাই।  

আরো পড়ুন:

আমি লেখক হয়ে উঠি আসলে ঘটনাক্রমে। আমার পূর্বপুরুষদের কেউই লেখক ছিলেন না, আবার সাহিত্যের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। আমার এক বন্ধু লেখালেখি করত, সেটা দেখে আমার মনে হলো যে- ও লেখালেখি করতে পারলে তো আমিও পারবো। এই চিন্তা থেকেই লেখালেখি শুরু। এটা এক ধরনের ছেলেমানুষী চিন্তা ছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালে ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় যখন আমার লেখা ছাপা হলো তখন লেখালেখিটা আমার নেশা হয়ে গিয়েছিল। সেই বয়সে একটা ছেলের লেখা খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে, তার নামসহ ছাপা হচ্ছে, সেই লোভে আমি বহুদিন লিখেছি। তখন আমি সাহিত্য ভালো করে ঠিক বুঝতামও না। পরিকল্পনা করে আমি এই জগতে আসিনি। 

আপনার প্রথম লেখা বড়োদের জন্য ‘শঙ্খিনী’কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেটা বাংলাদেশে কোথাও প্রকাশ করেননি কেন বা হয়নি কেন? 

এই গল্পটা ছিল ১৯৭৪ সালের শুরুর দিকে বা শেষ দিককার কথা। একটা ছেলে তার দুঃসম্পর্কের ফুপু, যে তার কাছাকাছি বয়সের বা একটু ছোটো। গল্পটা একটু কাঁচা হাতে লেখা। আমি যে সম্পাদকদের ছাপতে দিয়েছিলাম তাদের ধারণা ছিল এটা ওই ফুপুর সাথে প্রেমের ইঙ্গিতের গল্প, একটা নষ্ট সম্পর্কের গল্প। কিন্তু আসলে এ রকম কিছু না। তখনো তো আমাদের সমাজব্যবস্থা এবং সাহিত্য সেই উদার জায়গায় পৌঁছায়নি। সম্পাদকরা আমার সেই গল্পটা ফিরিয়ে দিল, গালাগাল এবং ধমক দিল, বেশ কয়েকজন অপমানও করলো। গল্পটা এরপরে আমি কলকাতায় সে সময়ের নামকরা ‘অমৃত’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দেই। পরের সপ্তাহেই ওরা ছাপিয়ে দিল। গল্পটা আমার লেখালেখির ভিত্তি অনেকটা শক্ত করে দিয়েছিল। 

আপনার কি মনে হয়, বাংলাদেশে সাহিত্যের মুক্তজগৎ তৈরি হয়েছে? লেখকরা ইচ্ছেমত বিষয়ে লিখতে পারেন? 

যেভাবে খুশি আসলে সেভাবে তো সাহিত্য লেখা যায় না। প্রত্যেক লেখকেরই সেলফ এডিটিং থাকে। তিনি যে বিষয়টা নির্বাচন করবেন, তার সঙ্গে সাহিত্যে তাঁর কল্পনার জগতকে মেশাবেন। এ জন্যই তো সাহিত্য হয়ে ওঠে। সাহিত্যে কল্পনার আশ্রয় থাকে লেখকের। লেখক তো আসলে সব বিষয় লিখবেন না। তিনি তার পছন্দের বিষয় নিয়ে লিখবেন। 

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আপনার অনেক গল্পে রতন একটি বিশেষ চরিত্র। রতন কি আপনার বিশেষ পরিচিত বা চারপাশের কেউ? 

এটি একটি ভালো প্রশ্ন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্পগুলোতে রতন নামটি অন্যতম একটি চরিত্র। আমি মনে করি যে, সে সময় যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভেবেছে, তারা সবাই রতন। তাদের আমি বাঙালি জাতির রত্ন মনে করি। রতন মানেই রত্ন। প্রতীক অর্থে আমি এই চরিত্রটিকে ব্যবহার করি। 

আপনার অনেক গল্প এবং উপন্যাসে মাতৃভূমি এবং মুক্তিযুদ্ধকে একই সূত্রে গেঁথেছেন। বিভিন্ন চরিত্র এঁকেছেন যারা দেশ এবং মাটির কাছাকাছি থাকলে ভালো বোধ করে। তেমন একটা চরিত্র  মতি মাস্টার। 

লেখক হিসেবে আমার দেশপ্রেম খুবই তীব্র। বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে লিখছি, বাংলাদেশের স্বাধীন মাটিতে বসে গল্প লিখছি এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আমার জীবনে আর কিছু নেই। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, মানুষের দুটো মা থাকে। এক মা তাকে জন্ম দেয় এবং অন্য মা তার দেশ। আমার কাছে দুই মায়ের গুরুত্বই সমান। আমি আমার দুই মাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি। 

‘নূরজাহান’ আপনার বহুল পঠিত উপন্যাস। ওই ঘটনাটি সিলেট অঞ্চলের। কিন্তু উপন্যাসে সিলেট অঞ্চলের ভাষা আপনি ব্যবহার করেননি।  

এর অন্যতম কারণ, ওই অঞ্চলের ভাষা আমি ভালোভাবে জানি না। ভাষা প্রাঞ্জল না হলে অন্য এলাকার লোকেরা সেই ভাষা বুঝবে না। কিন্তু ঢাকা বা বিক্রমপুর এ দিকের কমন আঞ্চলিক ভাষা সবাই বুঝতে পারে। আমি নূরজাহানকে একটি প্রতীকী চরিত্র হিসেবে তৈরি করেছিলাম। বিভিন্ন গ্রামে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন বহু নূরজাহান রয়েছে যারা ফতোয়ার জন্য নির্যাতিত-নিপীড়িত হচ্ছে। যারা মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। নূরজাহান যেহেতু সমগ্র বাংলাদেশেই আছে তাই তাকে যে কোনো একটা জায়গায় তুলে ধরাই যায়। বিক্রমপুরের পটভূমিতে নিয়ে এলাম এবং সাচ্ছন্দ্যে আমি আমার উপন্যাসটি লিখতে পারলাম। তাছাড়া একটি বড়ো চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে তার চারপাশে অনেক মানুষ লাগে। সেসব কারণেই নূরজাহানকে বিক্রমপুরের পটভূমিতে নিয়ে আসা।  

আপনার অনেক গল্পে প্রেম দারুণভাবে এসেছে। আপনার গল্পের প্রধান বা উপজীব্য বিষয় কী?

আমি যখন লেখালেখি শুরু করি, এক পর্যায়ে মনে হলো, আমার নামটা যেন মানুষ জানে। আমার লেখা যেন মানুষ পড়ে। বাঙালি পাঠক কি ধরনের লেখা বেশি পড়ে? গৃহবধূ, ছাত্ররা কী ধরনের লেখা পছন্দ করে? আমি দেখলাম প্রেমের গল্প সবচেয়ে বেশি পড়ে। সবচেয়ে বেশি পঠিত। এরপর আমি একের পর এক প্রেমের গল্প লেখা শুরু করলাম। যদি কিছুটা জনপ্রিয় হয়ে থাকি সেটা আমার প্রেমের লেখার জন্য। ‘কালো ঘোড়া’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘পরাধীনতা’, ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’ বা ‘পর’ এসব উপন্যাস কিন্তু সেই অর্থে জনপ্রিয় না, যে অর্থে ‘ভালোবাসার সুখ দুঃখ’ জনপ্রিয়। ‘এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’যে অর্থে জনপ্রিয় সে অর্থে কিন্তু ‘নূরজাহান’ জনপ্রিয় নয়। একটা সময় আমি জনপ্রিয় লেখক হতে চেয়েছি বলেই প্রচুর প্রেমের গল্প লিখেছি। 

আপনার গল্প, উপন্যাসে নারী নির্যাতনের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে- এর বিশেষ কোনো কারণ আছে? 

নারী নির্যাতন এবং নারীর অসহায়ত্ব আমার উপন্যাসে উঠে এসেছে। আমার একটি গল্প আছে ‘জোসনা রাতে তিনটি মেয়ে’। গ্রামের বাইরে থেকে সেই মেয়েদের পরিবার দেখে কেউ বুঝতে পারছে না তারা কীভাবে চলছে। সেই মেয়েগুলো হয়তো পতিতাবৃত্তি করে। এই যে নিম্নবিত্তের জীবনযাপনের নানা ধরনের পদ্ধতি এসব আমি আমার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। 

আপনার একটি বইয়ের নাম ‘দ্বিতীয় প্রেম’। এমন নামকরণের কারণ কী? প্রতিটি প্রেমই কি প্রথম প্রেম নয়?

লেখাটা লিখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, একজন মানুষ জীবনে প্রথম একবার প্রেমে পড়েছিল এবং পুনরায় দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েছে। উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে আমার যে অনুভূতি, আমার মনে হয়েছিল মানুষের জীবনে প্রেম একবার আসে না। মানুষের বিভিন্ন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রেমের কনসেপ্ট বদলায়। মানুষ বারবার প্রেমে পড়তে পারে।  

উপন্যাসে কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ?

আমি আমার ভাবনার কথা বলি। এখানে তিন-চারটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি প্রথমে একটা থিম ভাবি, যে থিমের উপর লেখাটা দাঁড় করাবো। ধরা যাক পদ্মার বুকে নতুন করে জেগে ওঠা একটা চর আমার থিম। এখন সারাদেশে নদীগুলোতে চর পড়ছে একের পর এক। ভাবলাম যে চরজীবন নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব। এটা কিন্তু শুধুমাত্র আমার ভাবনা। এরপর আমি ভাবতে থাকবো-  চরের ডিটেইল কী কী হতে পারে, চর জেগে ওঠে কীভাবে, মানুষ দখল করে কীভাবে, মানুষের সেখানে বসতি গড়ে ওঠে কীভাবে, মানুষের চরিত্রের মাধ্যমে কীভাবে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, দখলদাররা সেখানে কী করে, রাজনৈতিক নেতারা সেখানে কী করে, সেখানে নারীদের জীবন কীভাবে চলে ইত্যাদি। এরপর প্রকৃতির সাথে সেই অঞ্চলের ভাষা যুক্ত হয়। ভাষা কেন গুরুত্বপূর্ণ? আমি এখন তোমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলছি পদ্মার চরে যারা থাকে তারা এভাবে কথা বলে না। সুতরাং তাদের ভাষাটাও একটা খুব বড়ো ব্যাপার। সেখানটার উপমাটা কি রকম হবে সেটাও ভাবতে হয়। ধরো আমার চরজীবন নিয়ে লেখা একটা উপন্যাসে একটা বাচ্চা ছেলে। আমি তার শরীরের বর্ণনা দিলাম গোধূলি বেলার চরের নতুন পলি মাটির মতো তার গায়ের রং। তুমি কিন্তু ভাবনাটা দেখতে পাচ্ছ। লেখক তো আসলে এ ভাবে তৈরি হয় এবং লেখক তার লেখাটা এভাবে তৈরি করেন। 

তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়