এক হাতেই সাইফুলের জীবনযুদ্ধ
অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
প্রতিটি মানুষের জীবনেই কঠিন সময় পার করতে হয়। কেউ হেরে যান, কেউ আত্মবিশ্বাষ বাড়িয়ে লড়াই করে এগিয়ে যান। তবে সব কষ্টের হানা যার জীবনে, তিনি সাইফুল ইসলাম। এক হাত নিয়েই বেঁচে থাকার জন্য রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। যে বয়সে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে হাসি-খুশিতে সময় কাটানোর কথা, তখন তিনি জীবিকার সন্ধানে রিকশা চালাচ্ছেন।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৭৫)। তার দুই ছেলে। বড় ছেলে নুর-নবী রাজমিস্ত্রি ও ছোট ছেলে ইউসুফ আলী এইচএসসি পাস করে বাড়িতে বেকার হয়ে আছেন। দুই ছেলে থাকা সত্ত্বেও এখনো তাকে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। প্রায় ৪০ বছর ধরে রিকশা চালান সাইফুল ইসলাম। প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরবেলা উঠে এক হাত নিয়ে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বউ ছেলের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছেন। দীর্ঘ দিন এভাবেই পরিশ্রম করতে করতে বর্তমানে নানা রোগে আক্রান্ত তিনি। তাই নিয়মিত কাজ করতে পারেন না। তারপরও জীবিকার তাগিদে তাকে বের হতে হয়।
জীবনযুদ্ধে হার না মানা সাইফুল ইসলাম বলেন, বয়স মাত্র ১২। সেই সময় গাছ থেকে পড়ে প্রাণে বেচেঁ গেলেও বাম হাত ভেঙে যায়। সেই থেকেই জীবনে নেমে আসে জীবনের কালো অধ্যায়। কৃষক বাবার সাধ্য অনুয়ায়ী ডাক্তার ও কবিরাজকে দিয়ে চিকিৎসা করে ছিলেন। কিন্তু ভাঙা হাতে ইনফেকশনের কারণে অবশেষে চিকিৎসার মাত্র ১ মাসের মাথায় আমার বাম হাত কেটে ফেলে দিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, হাত কেটে ফেলার কিছু দিন পরে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। তখন মা-বাবার সাথে রাজশাহী জেলায় আত্মীয়র বাড়ি চলে যাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। বাবার সাথে স্থানীয় বাজারে কাঁচা-মাল বিক্রি করতে থাকি। পরে বিয়ে করি। বিয়ের ৩ বছরের মাথায় বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর কিছু দিন পরে মাও মারা যান।
ঘরে বউ ও সন্তানদের নিয়ে কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছিল। জমি-জমা না থাকায় রিকশা চালানো শুরু করি। এক হাত না থাকায় অনেক যাত্রী রিকশায় উঠতো না। অনেক কষ্ট করে সংসারসহ দুই ছেলেকে বড় করেছি। এখন ছেলেরা বড় হয়েছে। তবুও রিকশা চালাতে হয়।
সাইফুলের বড় ছেলে নুরনবী বলেন, বাবা অনেক কষ্ট করে আমাদের বড় করেছেন। আমাদের জমি-জমা নেই, এজন্য বৃদ্ধ বয়সে বাবা এখনো রিকশা চালাচ্ছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ার পরেও এখনো পর্যন্ত কোনো সরকারি সহয়তা পাননি আমার বাবা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহাদৎ হোসেন বলেন, দীর্ঘ দিন এক হাত নিয়েই রিকশা চালিয়েছেন সাইফুল। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ১ লাখ টাকা কিস্তিতে ঋণ গ্রহণ করে ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা তৈরি করেছেন তিনি। বর্তমানে দিয়ার পাচিল, খোকশাবাড়ি, গুনের গাতী ও পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় রিকশা চালিয়ে জীবনযাপন করছেন তিনি।
খোকশাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রাশিদুল হাসান রশিদ মোল্লা জানান, সাইফুল প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি না করে কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। যত দ্রুত সাইফুল সহয়তা পান, সেই ব্যবস্থা করা হবে।
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনোয়ার পারভেজ বলেন, আপনাদের মাধ্যমে সাইফুলের বিষয়টি জানতে পারলাম। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে সহযোগিতা করা হবে।
জেলা রিকশা ও ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মানব সরদার বলেন, জেলায় প্রায় ৬ হাজারের অধিক লাইসেন্স করা রিকশা ও ভ্যান রয়েছে এবং লাইসেন্স ছাড়া আরও প্রায় ৯ হাজারের মতো রিকশা ও ভ্যান রয়েছে। কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় মারা গেলে বয়স অনুযায়ী তার পরিবারকে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে এককালীন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
/মাহি/
আরো পড়ুন