পরিত্যক্ত স্টেশন, ঘাসে বসে ট্রেনের অপেক্ষা
পঞ্চগড় প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
ঘড়িতে তখন দুপুর আড়াইটা ২টা। একটি কমিউটার ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা আয়েশা সিদ্দিকা। ট্রেন স্টেশনে আসবে আরো এক ঘণ্টা পর। স্টেশনটিতে বিশ্রামাগার থাকা তো দূরের কথা বসার ব্যবস্থাও নেই। তাই স্টেশনের সামনে লাইনের পাশে ঘাসে বসেই অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন তিনি।
এই বৃদ্ধার মত আরো অর্ধশত যাত্রী অপেক্ষা করছিলেন ট্রেনটির। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। তাদের সবার অপেক্ষা দুপুর ৩টা ১০ মিনিটে পঞ্চগড় সদর বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেল স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা দিনাজপুরের পার্বতীপুরগামী ‘কাঞ্চন কমিউটার’ ট্রেনের।
মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে এমন দৃশ্য চোখে পড়ল পঞ্চগড় সদর উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের নয়নিবুরুজ রেল স্টেশনে। এ স্টেশনের উপর দিয়ে নিয়মিত চলচল করে আন্তনগর ট্রেন ‘একতা এক্সপ্রেস’ ‘পঞ্চগড় এক্সপ্রেস’ এবং ‘বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস।’ এর মধ্যে ‘বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি যায় রাজশাহীতে বাকি দুটি ট্রেন ঢাকায় চলাচল করে। তবে এ ট্রেনগুলি নয়নিবুরুজ রেল স্টেশনে কোনো যাত্রাবিরতি দেয়না।
সরেজমিনে গিয়ে পরিত্যক্ত প্রায় স্টেশনটি দেখভাল করে এমন কাউকে দেখা যায়নি। তালাবদ্ধ স্টেশনটিতে নেই কোনো যাত্রী সেবা। হয়না টিকিট বিক্রিও। স্টেশনের অবকাঠামো নড়বড়ে হওয়ায় চরম ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন যাত্রীরা।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই স্টেশনে ‘কাঞ্চন’, ‘পঞ্চগড়’ কমিউটারসহ বগুড়ার সান্তাহারগামী ‘উত্তরবঙ্গ মেইল’ ট্রেন যাত্রা বিরতি দিয়ে আসছে। করোনা মহামারীর পর থেকে এক জোড়া ‘পঞ্চগড়’ ও ‘উত্তরবঙ্গ মেইল’ ট্রেনটি বন্ধ আছে। তবে ‘কাঞ্চন কমিউটার’ নিয়মিত চলাচল করছে। প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রী নয়নিবুরুজ স্টেশন থেকে এই ট্রেনে দিনাজপুরের পার্বতীপুর এবং পঞ্চগড় পর্যন্ত যাতায়াত করেছেন।
ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা যাত্রী গোলাম রব্বানীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি কমিউটার ট্রেনে দিনাজপুর যাবেন। এই ট্রেনে তিনি নিয়মিত যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, ‘নয়নিবুরুজ স্টেশনে আগে বেশ কয়েকটি ট্রেন যাত্রাবিরতি দিলেও এখন মাত্র একটি ট্রেন থামছে। কিন্তু এখানে ট্রেনের সঙ্গে স্টেশনের কোন সম্পর্ক নেই। স্টেশনে কোন জনবল না থাকায় যাত্রীরা যে যার মতো দাঁড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকেন।’
অমূল্য কুমার রায় নামের অপর এক যাত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার আগের এই স্টেশনটি বর্তমান অবহেলিত। বিলীনের পথে স্টেশনটি এখনি সংস্কার করে নতুন করে চালু করা দরকার। এছাড়া এই স্টেশনের উপর দিয়ে ঢকাগামী দুটি ট্রেন চলাচল করে। এখন থেকেও অনেক মানুষ ঢাকায় যায়। তাই যাত্রীদের সুবিধার্তে এখানে একটি হলেও আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়া উচিত।’
স্থানীয় ব্যবসায়ী আহসান হাবিব ট্রেনে করে বিভিন্ন জায়গায় শুকনো মরিচ পাঠান। তিনি বলেন, ‘স্টেশনে প্লাটফরম না থাকায় মরিচের বস্তা ওঠানামা করতে ঝামেলা হয়। স্টেশনে জনবল না থাকায় পণ্য বুকিং দিতে হয় অন্য স্টেশন থেকে। এতে যেমন সময় অপচয় হয় তেমনি ভোগান্তিও বাড়ে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, বিকেল ৩টা ৩৩ মিনিটে ‘কাঞ্চন কমিউটার’ ট্রেনটি নয়নিবুরুজে প্রবেশ করে। স্টেশন অতিক্রম করে ট্রেনটি দাঁড়ায়। এ সময় অপেক্ষারত যাত্রীদের দৌড়ে ট্রেনের বগির দরজার সামনে যেতে দেখা যায়। প্লাটফরম না থাকায় ট্রেনটিতে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছিলো যাত্রীদের।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মাসুদ পারভেজ নোবেল জানান, বন্ধ থাকা পঞ্চগড়’ ‘উত্তরবঙ্গ মেইল’ ট্রেনটি চালুর ব্যপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগীয় ব্যবস্থাপক শাহ সুফী নুর মোহাম্মদ জানান, জনবল সঙ্কটের কারণে এমনটা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নতুন লোকবলের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে রেল বিভাগ। নতুন নিয়োগ হলে শিগগিরই এই সঙ্কট কেটে যাবে। এই স্টেশনটির কাঠামোগত উন্নয়নে রেল বিভাগের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রেলপথে অবস্থিত নয়নিবুরুজ স্টেশনটি ১৯৬৭ সালে তৈরি করা হয়।
নাইম/মাসুদ
আরো পড়ুন