ঢাকা     রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

পদ্মা সেতু: খুশির মধ্যেও দৌলতদিয়া ঘাটে রুটি-রুজির শঙ্কা 

সুকান্ত বিশ্বাস, রাজবাড়ী  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৫৩, ৮ জুন ২০২২   আপডেট: ২২:২৩, ৮ জুন ২০২২
পদ্মা সেতু: খুশির মধ্যেও দৌলতদিয়া ঘাটে রুটি-রুজির শঙ্কা 

দৌলতদিয়া ঘাটের হোটেল

দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বহুল প্রতীক্ষার পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে ২৫ জুন। সেতু ঘিরে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই দক্ষিণবঙ্গের মানুষের। একইসঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট দৌলতদিয়া-পাটুরিয়াও থাকছে সচল। পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার হলেও এই নৌপথেও যানবাহন পারাপার হতে পারবে। এই নৌরুটে সারা বছর যে ভোগান্তি থাকে, তখন তা কমে আসবে। তবে যাত্রী ও বাস কমে যাওয়ায় শঙ্কায় চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। 

ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, সেতু খুলে দিলে দৌলতদিয়া ফেরি রুটে যানবহন ও যাত্রীর চাপ অনেক কমে যাবে। ফলে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকার খাবার হোটেল থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ দোকান ও হকারের বিক্রি কম যাবে। 

দৌলতদিয়া ঘাট এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, এই পাড়ে দেড় শাতাধিক টঙ দোকান রয়েছে। যাত্রী ও যানবাহনের চাপ কমে গেলে ব্যবসা কমে যাবে। তখন সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।

ঘাট এলাকায় দুইশত বেশির খাবার হোটেল রয়েছে। তাছাড়াও ভ্যানে করে বা মাথায় করে পেয়ারা, ডাব, আনারস, ডিম ও ঝালমুড়ি বিক্রি করে তিন শতাধিক ব্যক্তি। পদ্মা সেতু চালু হলে এই ফেরিরুটে যাত্রী ও যানবহন কমে তাদের বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এ সকল হকাররা।

রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া (কুমারখালী, খোকসা), ফরিদপুর (সদর) থেকে মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ার যানবাহনগুলো দৌলতদিয়া ঘাট হয়ে যাবে বলে ঘাট ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন বা বিআইডব্লিউটিসি বলছে, কত সংখ্যক যানবাহন ও যাত্রী এই নৌপথ দিয়ে চলাচল করবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। পদ্মা সেতু চালু হলে অল্প দিনের মধ্যে তা বোঝা যাবে। 

দৌলতদিয়া ঘাটের গ্রামীণ হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের মালিক টিটু শেখ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে ইদানিং তার ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় তিনি শঙ্কায় রয়েছেন। সেতু চালু হলে এই অবস্থা আরও খারাপ হবে বলে তিনি মনে করেন।

টিটু শেখ বলেন, ‘মাসে আমার প্রায় ২ লাখ টাকা শুধু দোকান বাবদই খরচ হয়। তারপর সেখান থেকে আয় দিয়ে আমার সংসার চলে। এখনই যদি ব্যবসায় মন্দ হয়, সেতু চালু হলে দোকান বন্ধ করে চলে যেতে হবে।’ 

আরেক হোটেল ব্যবসায়ী লোকমান ফকির। দৌলতদিয়া লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বের হলেই তার খাবারের দোকান চোখে পড়ে। ভাই ভাই হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট। লোকমান ফকিরের কণ্ঠেও একই সূর। তিনি বলেন, ‘যানবাহন, যাত্রী কমে গেলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। হোটেল ভাড়া, কারেন্ট বিল, কর্মচারীর বিল দিয়ে আমরা হোটেল চালাতে পারবো না।’ 

কয়েকজন হোটেল কর্মচারীর সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, ‘যদি যাত্রী আর গাড়ি না থাকে মালিকের বেচাকেনা হবে না। আগের মতো রমরমা অবস্থা থাকবে না। তখন আমাদের চাকরিও থাকবে না। বউ-বাচ্চা নিয়ে কোথায় থাকবো? একে তো নদী ভাঙন আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে, এরপর আমাদের কী হবে?’

টার্মিনাল এলাকায় ঘোল ব্যবসায়ী রতন ঘোষ। তিনি বলেন, ‘এই ব্যবসা আমার বাপ-দাদার আমলের। এমনও দিন গেছে, ৩ থেকে ৪ পাতিল ঘোল বিক্রি হয়েছে। এখন এক থেকে দেড় পাতিল বিক্রি হয়। সেতু চালু হলে না জানি কী হবে ব্যবসার?’

ছোট মুদি দোকান চালায় নুরুল আনোয়ার মিলন। তিনি বলেন, ‘এটা তো জেলাশহর না যে মানুষ আসবেই। ঘাটে যাত্রী, গাড়ি পারাপার হতো; তাই মানুষ আসতো। সেতু চালু হলে মানুষ কম আসবে। তখন আমাদের দোকান বন্ধ করে রাখতে হবে।’ 

দীর্ঘদিন ধরে ১নং ফেরিঘাটের পাশে চায়ের দোকান করে মোসলেন উদ্দিন। মোসলেন বলেন, ‘এইখানে চায়ের দোকান করে ২ ছেলে, ৩ মেয়ে আর বউ নিয়ে সংসার চালাই। যদি ঘাটে যাত্রী কমে যায়, আমাদের ব্যবসা কমে যাবে। আমাদের দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হবে তখন।’ 

আরেক মুদি দোকানি সালাম বলেন, ‘ঘাটে যাত্রী, বাস, ট্রাক আসে বলেই দোকান চলে। যদি গাড়ি অর্ধেক কমে যায়, তখন যানজট থাকবে না। ফেরিতে গাড়ি সরাসরি উঠবে। তখন আমাদের আর ব্যবসাও হবে না।’ 

ভ্যান গাড়িতে করে লেবুর সরবত বিক্রি করেন আকবর। তিনি বলেন, ‘এখন যাত্রীর চাপ আছে। গরমের সময় ভালোই বিক্রি হয়। যদি যাত্রী কমে যায়, তখনকার অবস্থা নিয়ে শঙ্কায় আছি।’ 

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক লীগের দৌলতদিয়া শাখার সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন তপু বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে এই ঘাট এলাকায় ১ হাজার হকার, ১০০ হোটেল, ২০০ ছোট ব্যবসায়ী, ২০০ বাড়ি কেন্দ্রিক যে ব্যবসা আছে, তা শেষ হয়ে যাবে। প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। তারা পেশা পাল্টাতে বাধ্য হবে।

রাজবাড়ী বাস মালিক সমিতির সেক্রেটারি মুরাদ হাসান মৃদা বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের পরিবহন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তখন বরং আমরা স্বল্প সময়ে ফেরি পাব, দুর্ভোগ কমবে।’ 

তিনি আরও বলেন, রাজবাড়ী, ফরিদপুর (সদর), মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া (কুমারখালী) এসব রুটের যাত্রীরা এই ঘাট ব্যবহার করবে। ২১ জেলার চাপ না থাকায় তখন এই কয়েক জেলার যাত্রীরা দুর্ভোগ ছাড়াই পারাপার হতে পারবে। 

তবে পদ্মা সেতু চালু হলে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে কয়টি ফেরি চলবে,  সেই বিষয়ে নিশ্চিত করে এখনও কিছু বলতে পারছে না বিআইডব্লিউটিসি সংশ্লিষ্টরা। বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম এবং পাটুরিয়া ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ জানান, যানবাহন ও যাত্রীর উপর নির্ভর করে ফেরি চলবে।

তিনি মনে করেন, লাইট ট্রাক বিশেষ করে এক, দেড়, আড়াই, তিন টনের ছোট পিকআপ পদ্মা সেতু হয়ে ২১ জেলায় যাতায়াত করবে। তবে পণ্যবাহীসহ বড় ট্রাক আগে মতোই এই নৌরুটে চলবে। রাজবাড়ীসহ বেশ কয়েকটি জেলার, বিশেষ করে গাবতলী থেকে ছেড়ে আসা পরিবহনগুলো দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে পারাপার হবে। 

ভ্রাম্যমাণ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকাররা তাদের ব্যবসা নিয়ে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সেই বিষয়ে খালেদ নেওয়াজ বলেন, মূলত সেতু চালুর দু-এক সপ্তাহ পরে বাস্তবতা বোঝা যাবে।
 

/বকুল/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়