ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মনিষ দেওয়ানের নেতৃত্বে রাঙামাটিতে উত্তোলন হয় স্বাধীন দেশের পতাকা

বিজয় ধর, রাঙামাটি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২  
মনিষ দেওয়ানের নেতৃত্বে রাঙামাটিতে উত্তোলন হয় স্বাধীন দেশের পতাকা

বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল (অব.) মনিষ দেওয়ান।

আমি যখন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার বয়স ছিল ১৯ বছর। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধের যখন ঘোষণা আসে তখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবো এই দেশ এবং এ দেশের মাটি ও মানুষের জন্য। এরপর আমি আর বসে থাকিনি। যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য এপ্রিল মাসেই ভারতের দেরাদুনে চলে যাই। সেখানে ১ নম্বর সেক্টরে প্রায় ২ মাস প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে তৎকালীন বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট এ যোগদান (শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো) করি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে (রাঙামাটি) প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল (অব.) মনিষ দেওয়ান তার স্মৃতিচারণে  এ কথাগুলোই বলেছেন।

কর্ণেল (অব.) মনিষ দেওয়ান বলেন, ‘ভারতের মিজোরামের দেমাগ্রীতে ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের সদর দপ্তর। সেখান থেকেই রাঙামাটি দখল করার পরিকল্পনা করা হয় ডিসেম্বরের ১২-১৩ তারিখের দিকে। সে অনুযাযী ১৫ ডিসেম্বর সকাল ৯ টার দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক কোম্পানি সেনা ও মুক্তিযোদ্ধারা রাঙামাটি থেকে ৯ মাইল দূরের কুতুকছড়িতে হেলিকপ্টার থেকে অবতরণ করে। এর এক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি বহর আমাদের আক্রমণ করার জন্য রাঙামাটি শহর থেকে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। বর্তমানে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ির যে সড়কটি ১৯৭১ সালে সেটি ছিল পায়ে হাঁটা মেঠো পথ। আসল রাস্তাটি ছিল পাহাড়ে উপরে যেটি দিয়ে সাধারণত চলাচল করতে হতো। পাকিস্তানিরা সেখানে অবস্থান নেয় এবং আমাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। আমরাও পাল্টা আক্রমণ করি। ১৫ ডিসেম্বর সারাদিন দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। রাতে যুদ্ধ কিছুটা শান্ত হয়। 

তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান দৃড় করে। আমরাও আমাদের অবস্থান দৃড় করি রাতের মধ্যে। ১৬ ডিসেম্বর ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। বিকালের দিকে যুদ্ধ স্থিমিত হয়ে যায় হঠাৎ পাকিস্তান আর্মি নীরবতা পালন করে। আমরা সেই সুযোগে কুতুকছড়ির মূল অবস্থান থেকে একটু সামনের দিকে এগিয়ে এসে রাস্তার পাশাপাশি স্থানে অবস্থান করি। ১৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ৩ টার দিকে হঠাৎ আমরা বিকট একটা আওয়াজ শুনতে পাই। সেই আওয়াজটা ছিল ডিনামাইট দিয়ে রাঙামাটির মানিকছড়ি ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার শব্দ। আমাদের যিনি কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর মেজর সুরি বললেন, তুমি (আমি) এবং শামসুদ্দিনসহ সবাই এখন রাঙামাটি অভিমুখে যাবো। মনে হচ্ছে পাকিস্তান সেনারা সম্ভবত পালিয়ে গেছে।
সকালে আমরা রাঙামাটি ডিসি অফিসে (বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড) সম্মুখে অবস্থান নিতে শুরু করি। ওইদিন জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে পতাকা উত্তোলন করা হয়। আমার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই মিলে পতাকা উত্তোলন করি। 

কর্ণেল (অব.) মনিষ দেওয়ান বলেন, ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮-৯ টার দিকে আমি আর শামসুদ্দিন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গিয়ে খুঁজতে থাকি সেখানে কোনো কর্মকর্তা আছেন কিনা। পরে একজনকে খুঁজে পাই। তিনি আমাদের জন্য বাংলাদেশের পতাকা ব্যবস্থা করে দেন। যেহেতু আমি পার্বত্য চট্টগ্রামেরই একজন বাসিন্দা রাঙামাটির স্থানীয় এই খবর জানতে পেরে পাহাড়ি-বাঙালি শিশু-পুরুষ-মহিলা থেকে শুরু করে হাজারো মানুষ আমাদেরকে দেখার জন্য পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় জমায়েত হন। সেখানে সকাল ১০টার দিকে তৎকালীন ডেপুটি কমিশনারের অফিসের সামনে জেলা শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়। 

মনিষ দেওয়ান বলেন, ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলনের সময় যুদ্ধের ধবংস স্তুপের মধ্যে দিয়ে স্বজন হারাদের বিয়োগ ব্যথা ভুলে হাজার হাজার জনতা রাস্তায় নেমে আসে।

বীর এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ভারতের স্পেশাল সিকিউরিটি ফের্সের  কমান্ডার মেজর জেনারেল সুজান সিং উভান এবং শেখ ফজলুল হক মনি ১৮ ডিসেম্বর রাঙামাটি আসেন বিকেল ৩টার দিকে। তারা হেলিকপ্টার থেকে অবতরণের পর আবারো স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করেন। কিছু আনুষ্ঠানিকতাও করা হয়।

প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসে পাক বাহিনীর সেনারা রাঙামাটি, রামগড় ও বান্দরবান দখল করে। এরপর ১ নম্বর সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ জন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। এ দলকে পরবর্তীতে কোম্পানি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরাকে কোম্পানি কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়