ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

গ্যাস এবং বিদ্যুতের স্বল্পতায় হুমকির মুখে সিরামিক শিল্প

এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৫, ৩ জুন ২০২৩  
গ্যাস এবং বিদ্যুতের স্বল্পতায় হুমকির মুখে সিরামিক শিল্প

মেশিনের সাহায্যে সিরামিকের পণ্যে আকৃতি দেওয়ার কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা

মাটি আর কাসা পিতলের যুগে সিরামিকের পণ্য তৈরি করে তৈজসপত্রে বিপ্লব ঘটায় বগুড়ার ‘তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’।  বিভিন্ন আকৃতি এবং পাত্রের গায়ে আকর্ষণীয় নকশার কারণে খুব সহজেই মানুষের পছন্দের তালিকায় স্থান করে নেয় সিরামিকের তৈজসপত্র। যা এখনও বিদ্যমান। তৈজসপত্রে আমূল পরিবর্তন আনা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সিরামিক পণ্য তৈরির এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বছরে ৯ কোটি টাকার পণ্য তৈরি করছে। তবে সাম্প্রতি লোডশেডিং এবং গ্যাস স্বল্পতার কারণে সিরামিক শিল্প হুমকির মুখে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৯ সালে মরহুম আব্দুল জব্বার বগুড়া শহরের কলোনী এলাকায় ৯ বিঘা জমিতে তৈরির কাজ শুরু করেন। এক বছর পরে ৫০/৬০ জন শ্রমিক নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে যায়। শুরুতে ভারত ও ইংল্যান্ড থেকে আসতো কাঁচামাল। চট্টগ্রাম থেকে আনা ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে জাপানি প্রযুক্তিতে মাসে ৩ হাজার পণ্য তৈরি হতো। তবে কারখানাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘদিন পরিচালনার পর  ২০০১ সালে ফার্নেস অয়েলের দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ যাওয়ায় এবং সরকার থেকে ফার্নেস অয়েলে ভর্তুকি তুলে দিলে ২০০১ সালে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে গ্যাস সংযোগ এলে ২০০৯ সালে কারখানাটি আবারও চালু হয়। বর্তমানে মাসে কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে ২ লাখ পিস বাসনকোসন। 

এছাড়া এখানে তৈরি পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্লেট, গ্লাস, জগ, কাপ, মগ ও বাটিসহ ৬০ ধরনের জিনিসপত্র। বর্তমান বাজার অনুযায়ী এই পণ্যগুলোর মাসিক বিক্রি ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। কারখানায় কর্মরত ২৫০ শ্রমিক বছরে সাড়ে আট কোটি টাকার বেশি পণ্য উৎপাদন করছেন।

কারখানায় তৈরি কাপ সাজিয়ে রাখার কাজ করছেন দুই নারী

এদিকে, বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, দেশে ৭০টি কারখানা সিরামিক পণ্য উৎপাদন করছে। দেশে এখন সিরামিক শিল্পের বাজার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার।

কারখানার নারী শ্রমিকরা বলেন, অভাবের সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা পেতেই তারা কারখানায় কাজ করছেন। অন্যান্য কলকারখানার চেয়ে এই কারখানায় কাজের নিরাপত্তা বেশি এবং সুযোগ সুবিধাও বেশি।

তাজমা সিরামিকের মার্কেটিং অফিসার শামসুল হুদা বলেন, প্রতিদিন ৮ হাজার পিছ সিরামিকের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিতে। ঢাকায় আমাদের ডিলার আছে। তাদের কাছেই আমরা পণ্যগুলো পাঠাই। তারাই পুরো বাংলাদেশে সাপ্লাই দেয়। সেহেতু তারা যে আইটেম বেশি চায় সেই আইটেম আমরা বেশি প্রডাকশন দিয়ে থাকি। সিরামিক পণ্য তৈরির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৫-৭টি ধাপ রয়েছে। পরে ডেকোরেশনসহ ডিজাইন করে আমরা বাজারজাত করতে পারি।  

সিরামিক পণ্য তৈরিতে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ করছেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা

তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শরিফুজ্জামান বলেন, আমাদের উত্তরবঙ্গ তো পিছিয়ে পড়া জনপদ ছিলো। এখানকার জ্বালানির মূল উৎস ছিলো ফার্নেস অয়েল। তখন চট্টগ্রাম থেকে ফার্নেস অয়েল আনতে হতো। এটা একটা জটিল ব্যাপার ছিলো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। আমরা ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ফার্নেস অয়েল দিয়ে কাজ চালিয়েছি। কিন্তু ২০০১ সালে ফার্নেস অয়েলের ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়া হয় সরকার থেকে। ওই সময় তাজমায় প্রতিদিন সাড়ে ৬ হাজার ফার্নেস ওয়েল লাগতো। ফার্নেস অয়েলের দামের কারণে উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। ফলে ২০০১ সালেই তাজমা সিরামিকের উৎপাদন বন্ধ করা হয়। পরে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তাজমা বন্ধ ছিলো। ২০০৯ সালে চাইনিজ এক্সপার্টদের সহযোগিতায় গ্যাস বেজ ফার্নেসে আমরা চলে যাই। সেভাবে এখনও চলছে। এর মধ্যে আমরা যে ব্যাংকঋণে পড়েছিলাম প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে ঋণ পরিশোধ করেছি। বর্তমানে আমাদের কোন ঋণ নেই।

শরীফুজ্জামান বলেন, বর্তমানে ১০/১২টা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে সেগুলোর প্রডাকশন ক্ষমতা এবং কোয়ালিটি খুব উন্নত। যার ফলে বৈদেশিক বাজারে আমাদের সিরামিকের চাহিদা খুব ভালো। আমাদেরও এক্সপোর্টের অর্ডার আছে। তবে আমাদের সে সক্ষমতা না থাকায় আমরা অর্ডার নিতে পারছি না। তবে আমরাও এক সময় ইংল্যান্ডে পণ্য পাঠাতাম খুব অল্প পরিসরে। এখন আমরা দেশের বাজারেই সাপ্লাই করি শুধু।

মেশিনে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা

শরিফুজ্জামান বলেন, সিরামিক সেক্টরে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ এই দুটো যদি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পাওয়া যায় তাহলে ভালো করা যাবে।  কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে গ্যাস এবং বিদ্যুতের স্বল্পতার কারণে সিরামিক শিল্পটা হুমকির সম্মুখীন। এটা যদি বাড়তে থাকে তাহলে অনেক সিরামিক প্রতিষ্ঠান হয়তো বন্ধ হবার উপক্রম হবে। ইতোমধ্যে কিছু ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধ হয়ে গেছে।  আগে যখন বিদ্যুৎ স্বাভাবিক ছিলো তখন জেনারেট জ্বালানোর জন্য আমার মাসে ১ ব্যারেল তেল হলেই হয়ে যেত। এখন গড়ে ৬ ব্যারেল তেল লাগছে।  বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে সব মিলিয়ে আমার মাসে ৬০/৬৫ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। 

গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে গ্যাসের প্রেশার কম থাকে। গ্যাসের সরবরাহ ঠিক থাকলে কারখানায় আরও আধুনিক মানের পণ্য তৈরি সম্ভব হবে।

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ