ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

‘আমি সবাইকে খবর পৌঁছে দিয়েছি, আমার খবর কেউ নেয় না’

জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ১ ডিসেম্বর ২০২৩   আপডেট: ২২:১৭, ১ ডিসেম্বর ২০২৩
‘আমি সবাইকে খবর পৌঁছে দিয়েছি, আমার খবর কেউ নেয় না’

স্ত্রীর সঙ্গে সৈয়দ আহাম্মদ ভূঁইয়া

লক্ষ্মীপুরের ১১২ বছর বয়সী সংবাদপত্রের হকার সৈয়দ আহাম্মদ ভূঁইয়ার খবর এখন আর কেউ নেয় না। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই বৃদ্ধ ৪ বছর আগে পত্রিকা বিক্রি ছেড়ে জীবন বাঁচাতে শুরু করেছেন ভিক্ষাবৃত্তি। অথচ কিশোর বয়স থেকেই তিনি লক্ষ্মীপুর শহর ও পাশের এলাকায় সংবাদপত্র বিক্রি করে করতেন। 

সৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া জানান, তিনি যখন হকার জীবন শুরু করেন তখন বর্তমান বাংলাদেশ থেকে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো না। কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হত। ওইসব পত্রিকার কোনো কোনটির দাম ছিল দুই পয়সা। 

সৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়ার দেওয়া তথ্যমতে, তখনকার দৈনিক পত্রিকা দৈনিক তো পাওয়া যেতোই না, বরং কখনো কখনো আজকের পত্রিকা পাওয়া যেত এক সপ্তাহ পরে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে ‘দৈনিক আজাদ’সহ বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। প্রথম দিকে এসব পত্রিকাও পাওয়া যেত এক-দুই দিন পরপর। সেসময় তিনি পত্রিকা শহরের বাইরের বিভিন্ন এলাকার পাঠকের কাছে পায়ে হেঁটে পৌঁছে দিতেন। পত্রিকা হাতে পেতে পাঠকরা অপেক্ষায় থাকতেন সৈয়দ আহাম্মদের। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় তিনি পৌঁছে যেতেন বর্তমান লক্ষ্মীপুর শহরের চক বাজারস্থ পত্রিকার এজেন্সিতে। চুচ্ছা ব্যাপারী নামের জনৈক ব্যক্তি ছিলেন এই জেলার একমাত্র সংবাদপত্রের এজেন্ট।

তিনি আরও জানান, পরবর্তীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সংবাদপত্র প্রকাশনার প্রযুক্তির উন্নয়ণ ঘটলে পত্রিকার পাশাপাশি পাঠক সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। প্রথম দিকে দিনের পত্রিকা দিনে আসতে শুরু করে। পরবর্তীতে প্রতিদিনের পত্রিকা প্রতিদিন ভোরে আসতে শুরু করে। সৈয়দ আহাম্মদের কর্ম ব্যস্ততাও বৃদ্ধি পায়। ঘুম থেকে উঠেই চলে আসতেন লক্ষ্মীপুর শহরের মেসার্স গোলাম রহমান নামের পত্রিকার এজেন্সিতে। নির্দিষ্ট পরিমাণ পত্রিকা নিয়ে সারা শহরে খবর খবর চিৎকারে মাতিয়ে তুলতেন তিনি। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালতে নিয়মিত গ্রাহকদের কাছে পত্রিকার কপি পৌঁছে দিয়ে সারা শহর পায়ে হেঁটে খবর খবর চিৎকারে মাতিয়ে তুলে পত্রিকা বিক্রি করতেন সৈয়দ আহাম্মদ। এক সময় বয়স বৃদ্ধি পাওয়ায় শরীরের শক্তি কমতে শুরু করে। তখনো তিনি গ্রাহকদের হাতে পত্রিকা তুলে দিতেন। এমনকি শহরের রহমত খালী খালের পাশের একটি স্থানে বসে পত্রিকার ডিসপ্লে করে বিক্রি করতেন সৈয়দ আহাম্মদ। রোদ ও বৃষ্টির মধ্যেও কখনো সৈয়দ আহাম্মদ পত্রিকা বিক্রি বন্ধ করেননি।

ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালাচ্ছেন সৈয়দ আহাম্মদ

প্রায় শত বছর ধরে সংবাদপত্র বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন সৈয়দ আহাম্মদ। সংবাদপত্র বিক্রি তার পেশা ও নেশা হওয়ায় জীবনে অন্য কাজে জড়াননি তিনি। বয়সের কারণে নুয়ে যাওয়া সৈয়দ আহাম্মদকে এখন শারীরিক নানা অসুস্থতার কারণে বেশিরভাগ সময়ই শয্যাশায়ী থাকতে হয়। যার কারণে ৪ বছর আগে পত্রিকা বিক্রি বন্ধ করে দেন তিনি। কিন্তু স্ত্রী আর দুই নাতি-নাতনি মিলিয়ে ৪ জনের সংসারের বোঝা রয়েছে তার কাঁধের ওপর। বয়স্ক ভাতা যা পান তা দিয়ে কোনভাবেই চলে না সংসার। 

সৈয়দ আহাম্মদের দুই ছেলে। এদের মধ্যে একজন মারা গেছে। অপর সন্তু আবুর একটি চোখ নষ্ট। নিজের পরিবারের সদস্য নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে চলে তার জীবন। এক সময় তিনিও বাবার মতো পত্রিকা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বর্তমানে পত্রিকা বিক্রির আয় দিয়ে খরচ মেটানো যায় না বলে তিনিও পত্রিকা বিক্রি ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে আবুর আয়ের কোনো উৎস নেই। পরিবারের সদস্যদের আহার যোগাতে তাকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য তিনি কিছুই করতে পারেন না। তাই সৈয়দ আহাম্মদ এখন নিরুপায় হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করছেন।

সৈয়দ আহাম্মদ লক্ষ্মীপুর পৌর এলাকার বাঞ্চানগর গ্রামে ১৯১১ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মকরম আলী ও মায়ের নাম আম্বিয়া বানু। দারিদ্রতার কারণে তিনি পড়া লেখার সুযোগও পাননি।

সৈয়দ আহাম্মদ বলেন, ‘এক সময় আমি সবার কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছি, কিন্তু এখন কেউ আমার খবর রাখে না।’

লক্ষ্মীপুরের সংবাদপত্র এজেন্ট মো. গোলাম রহমানের মালিক মো. রাকিব হোসেন জানান, আমার দাদা মো. গোলাম রহমান পত্রিকার এজেন্ট চালু করেন। এরপর থেকেই আমাদের এখান থেকে পত্রিকা বিক্রি করতেন সৈয়দ আহাম্মদ। আমাদের এজেন্সিতে এলে আমরা সৈয়দ আহাম্মদকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করি।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম পাঠওয়ারী বলেন, সৈয়দ আহাম্মদের বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। তিনি আমাদের সঙ্গে যদি যোগাযোগ করেন তাহলে তাকে সহায়তা করার চেষ্টা করবো।

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ