ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

চট্টগ্রামে অবৈধ কাঠ পাচারে সহযোগী বন বিভাগের দুই চেক স্টেশন 

রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩২, ৯ জানুয়ারি ২০২৪  
চট্টগ্রামে অবৈধ কাঠ পাচারে সহযোগী বন বিভাগের দুই চেক স্টেশন 

চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে হাজার হাজার ঘনফুট অবৈধ কাঠ পাচারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগীতা করে প্রতি মাসে কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করছে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন হাটহাজারী চেক স্টেশন এবং ফৌজদার হাট চেক স্টেশন বলে অভিযোগ উঠেছে। কাঠ পাচার প্রতিরোধের পরিবর্তে প্রতিদিন অবৈধ কাঠ পরিবহনে সহযোগির ভূমিকা পালন করছে বন বিভাগের এই দুটি স্টেশন। এসব স্টেশনে দৈনিক ঘুষ আদায় হয় দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। 

মূলত হাটহাজারী চেক স্টেশন কর্মকর্তা ফরেস্টার রাজিব উদ্দিন ইব্রাহিম এবং ফৌজদার হাট স্টেশন কর্মকর্তা মনজুরুল করিমের তত্ত্বাবধানে কাঠ পাচারে ঘুষ বাণিজ্য ওপেন সিক্রেট। ডিএফও এসিএফসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদায়কৃত ঘুষের একটি অংশ পৌঁছে দেওয়ায় তারা এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেন। 

সরেজমিনে অনুসন্ধান এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রকাশ্য ঘুষ আদায়ের চিত্র পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও ফটিকছড়ি বন অঞ্চল থেকে যেসব কাঠবাহী ট্রাক কাভার্ডভ্যান চট্টগ্রাম ও ঢাকার উদ্দেশ্যে যায় সেসব ট্রাক ট্রানজিট পাশ (টিপি) বা কাঠ পরিবহনের বৈধ অনুমতি আছে কি-না তা চেকিং-এর জন্য থামানো হয় হাটহাজারী থানার আওতাধীন ১১ মাইলস্থ হাটহাজারী চেক স্টেশন এবং সীতাকুণ্ডের ফৌজদার হাট চেক স্টেশনে। এই দুটি স্টেশনে চেকিংকালে যেসব কাঠের বৈধ ট্রানজিট পাশ থাকে সেগুলো থেকে প্রতি ট্রাকে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা এবং যেসব ট্রাকের কাঠ সম্পূর্ণ অবৈধ বা কোনো ট্রানজিট পাশ থাকে না সেগুলো থেকে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘুষের লেনদেনে হেরফের হলে মাঝে মধ্যে স্টেশনে কিছু কাঠ আটক দেখান এই কর্মকর্তারা।

খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় নিয়মিত কাঠের ট্রাক নিয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের কাঠ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘খাগড়াছড়ি থেকে বৈধ ট্রানজিট পাশ নিয়ে কাঠের ট্রাক ঢাকা যাওয়ার পথে হাটহাজারী চেক স্টেশনেে প্রতি ট্রাকে ৩২০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। সমপরিমাণ ঘুষ দিতে হয় ফৌজদারহাট চেক স্টেশনেও। একই ভাবে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি বন অঞ্চল থেকে যেসব কাঠবাহী ট্রাক ঢাকা যায় সেগুলো থেকে ঘুষ নেওয়া হয় প্রতি ট্রাকে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা।’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের অপর একজন কাঠ ব্যবসায়ী বলেন, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি বান্দরবান থেকে বৈধ কাগজপত্র নিয়ে ঢাকায় কাঠ পরিবহনের ক্ষেত্রে নিয়মিতই ঘুষ দিতে হয় ফৌজদার হাট চেক স্টেশনে। এটা ওপেন সিক্রেট বিষয়। লাখ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে এসব স্টেশনে পোস্টিং নেন স্টেশন কর্মকর্তারা। সেই টাকা আদায় করতে প্রকাশ্যে কাঠ পাচারে সহায়তা করে ঘুষ বাণিজ্য চালান তারা। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৈধ ট্রানজিট পাশ থাকলেও ঘুষ দিতে হয়, পাশ না থাকলে দিতে হয় কয়েকগুণ বেশি ঘুষ। আর এই সুযোগে কাঠ ব্যবসায়ীরা বন বিভাগকে ২০০ থেকে ২৫০ ঘনফুট কাঠে রাজস্ব দিয়ে পরিবহন করেন ৫০০ থেকে ৬০০ ঘনফুট কাঠ। ফলে বৈধ কাঠ পরিবহনের আড়ালে অবৈধ কাঠ পাচার করলেও ঘুষ নিয়ে চুপ থাকেন সংশ্লিষ্ট চেক পোস্টের কর্মকর্তারা। 

খাগড়াছড়ি, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি অঞ্চল থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ গাড়ি কাঠ, জ্বালানি কাঠ, বাঁশ ও অন্যান্য বনজদ্রব্য নিয়ে গাড়ি হাটহাজারী ও ফৌজদারহাট চেক স্টেশন অতিক্রম করে। সেসব গাড়ি থেকে প্রতিদিন ১ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় হয়। মূলত হাটহাজারী চেক স্টেশন কর্মকর্তা ফরেস্টার রাজিব উদ্দিন ইব্রাহিম এবং ফৌজদারহাট স্টেশন কর্মকর্তা মনজুরুল করিমের তত্ত্বাবধানে এই ঘুষ আদায় চলে প্রকাশ্যেই। 

জানা গেছে, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগে অত্যন্ত লোভনীয় পোস্টিং হিসেবে খ্যাত হাটহাজারী ও ফৌজদারহাট চেক স্টেশন। বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে (ডিএফও) ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় এসব স্টেশনে পোস্টিং পেতে। বড় অঙের টাকা ঘুষ দিয়ে পোস্টিং নেওয়ার পর প্রতি মাসেই স্টেশন কর্মকর্তা ঘুষ বাণিজ্য করেন ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। আদায়কৃত ঘুষের মধ্যে ৫০ শতাংশ স্টেশন কর্মকর্তা নিজে রাখেন এবং বাকি ৫০ শতাংশ ঊর্ধ্বতন এবং অধস্তনদের মধ্যে শতাংশ হারে বন্টন করেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শতাংশ হারে ঘুষের ভাগ পাওয়ায় স্টেশনের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধে তারা কোন ভূমিকা পালন করেন না। 

হাটহাজারী স্টেশন কর্মকর্তা রাজিব উদ্দিন ইব্রাহিম বলেন, স্টেশনে পোস্টিং নিয়ে বড় অঙের টাকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিতে হয়। এক বছর মেয়াদের পোস্টিংয়ে এক বছরের মধ্যেই লাভ সমেত ঘুষের টাকা তুলে নিতে হয়। তাই এখানে টিপি চেকিং বাবদ নির্দিষ্ট অঙের অর্থ আদায় অলিখিত নিয়ম। এগুলো লিখে কিছু হবে না।’ 

একই তথ্য জানান ফৌজদার হাট স্টেশন কর্মকর্তা মনজুরুল করিম। তার মতে, স্টেশনে এক বছরের জন্য পোস্টিং পেতে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। সেই টাকা আদায় করতেই মূলত অবৈধ কাঠ পাচারে সহাযোগিতা করতে হয়। 

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জয়নাল আবেদীন জানান, স্টেশন থেকে শতাংশ হারে ঘুষের ভাগ পাওয়ার বিষয়টি অসত্য। 

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়