ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মৌসুমের শেষে এসে আমচাষিরা শত কোটি টাকার লোকসানে

মেহেদী হাসান শিয়াম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ২৭ জুলাই ২০২৪  
মৌসুমের শেষে এসে আমচাষিরা শত কোটি টাকার লোকসানে

চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার আমের ফলনে বিপর্যয় হলেও চাষিরা ‘নায্য’ দাম পেয়ে খুশিই ছিলেন। গত ৫ বছরের রেকর্ড ভেঙেছিল চলতি মৌসুমের আমের দাম। কিন্তু কোটা বিরোধী আন্দোলনের ফলে মৌসুমের শেষের দিকে চাষিরা আম বিক্রয়ে বড় ধরনের ধাক্কা খেলেন। অন্ততপক্ষে শত কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয়েছে তাদের। 

ভোক্তার কাছে চাহিদা থাকার পরও পরিবহন বন্ধ থাকায় আম বিক্রি করতে পারেননি তারা। ফলে বাগানেই আম পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দামও প্রতিমণে ৫০০-৭০০ টাকা পর্যন্ত কম পেয়েছেন তারা।

আম চাষিদের সঙ্গে জানা গেছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জে আবহাওয়ার কারণে এবার আমের ফলনে বিপর্যয় ঘটেছে। আবার নতুন সৃজন হওয়া বাগানগুলোয় আমের ফলন ভালো হলেও পুরাতন বাগানগুলোর বড় আম গাছে আমই ধরেনি। অথচ এ জেলার প্রায় ৬০ ভাগ আম বাগানই পুরনো। এ অবস্থায় ফলন কম হলেও চাষিরা বেশি দামে আম বিক্রি করতে পারছিলেন। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমচাষিদের সে সম্ভাবনাটুকুও হারিয়ে যায়। তাই শুরুর দিকে চাষিরা বেশি দামে আম বিক্রি করতে পারলেও শেষের দিকে এসে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে।

শিবগঞ্জর আমচাষি মানারুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে আমের চাষের পাশাপাশি ব্যবসাও করেন। প্রায় দশবিঘা জমির ওপর ৪টি বাগান আছে তার। ছোট বাগানের গাছগুলোয় আমের ফলন হলেও বড়গুলোয় আম ধরেনি বললেই চলে। মানারুল বলেন- ‘চারটা বাগানের মধ্যে দুটি বাগানে মোটামুটি চলার মতো আম হয়েছে। শুরুর দিক থেকে বেশি দাম বিক্রি করেছি। কিন্তু শেষ দিকে এসে আমের দরপতন শুরু হয়েছে। শুধু মাত্র কোটা আন্দোলনের কারণে এমন ক্ষতি হয়েছে আমার। কিছু কিছু আম বাগানেই নষ্ট হয়েছে। বাজারে ক্রেতা না থাকায় আমও নামাতে পারিনি।’

আরেক আম চাষি ইমরান বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করলে কানসাট আম বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কমে যায়। ফলে বাজারে আম সরবরাহ কমে যায়, একই সঙ্গে দামও। যার কারণে অনেক চাষি গাছ থেকে আম নামানো বন্ধ করে দেন। শুধু শুধু তারা শ্রমিক দিয়ে ভ্যান ভাড়া করে আম আনতে যাবেন কেন? বাজারে ক্রেতা ছিল না বলে আমও কম নামতো।’ 

দেশের বৃহত্তম আম বাজার কানসাট। এই বাজারে চলতি মৌসুমে দৈনিক ২০-২৫ কোটি টাকা করে আমের বেচা-কেনা হয়েছে। কিন্তু কোটা আন্দোলনের ফলে আম পরিবহনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেচাকেনা কমে যায়। এই বাজারের আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক টিপু বলেন- ‘ সাধারণত চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকাসহ দূরবর্তী জেলায় আম পৌঁছানো হয় ট্রাক, পিকআপসহ অন্যান্য বাহনে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতায় যানবাহনের ক্ষতির আশঙ্কায় মালিকরা ট্রাক-পিকআপের ভাড়া দেননি। ফলে প্রতিমণ আমের দাম ৫০০-৭০০ টাকারও বেশি কমে যায়। একই সঙ্গে কানসাট আম বাজারেও বেচাকেনা কমে যায়।’

বন্ধ ছিল কুরিয়ার সার্ভিস

কোটা বিরোধী আন্দোলনের ফলে দেশজুড়ে যানবাহনে জালাও-পোড়াও শুরু হয়। তারপর থেকে কয়েকদিনের জন্য কিছু কুরিয়ার সার্ভিসের সেবা বন্ধ হয়ে যায়। গাছ থেকে নামানো আম অনেক সময় মতো ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে না পারার কারণে পচে নষ্ট হয়ে যায়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম চাকরি করেন ঢাকায়। আশুরার সঙ্গে বাড়তি কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসেন। তার সহকর্মীরা আম পাঠাতে বললে আম কিনে কুরিয়ার সার্ভিসে বুকিং করতে যান। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিস বন্ধ থাকায় তিনি পরে আমগুলো আর পাঠাতে পারেননি। 

সাইফুল ইসলাম বলেন ‘কুরিয়ার পয়েন্টে গিয়ে দেখি অফিসগুলো বন্ধ। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যানবাহনের ক্ষতির আশঙ্কায় কুরিয়ার সার্ভিসের সেবা আপাতত বন্ধ।’

আমের মৌসুমে কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিসের এজেন্সি নেন মোহাম্মদ সেফার আলী। তিনি মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন  ‘ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকার কারণে প্রায় সব কুরিয়ারের সার্ভার বন্ধ ছিল। যার কারণে কেউ বুকিং দিতে পারছিল না। ফলে ৪ দিনের জন্য কুরিয়ারের সার্ভিসের সেবা বন্ধ হয়ে যায়।’

অনলাইনের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত

লেখাপড়ার পাশাপাশি গত কয়েকবছর ধরে অনলাইনে আম বিক্রি করছিলেন গোমস্তাপুরের বাসিন্দা সাহাবুদ্দিন। চলতি মৌসুমে ফলন বিপর্যয় ও দাম বেশি হওয়ায় এবার আমের ব্যবসায় খুব একটা লাভবান হতে পারেননি এই যুবক। আকস্মিকভাবে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোক্তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় তার। যার কারণে তিনি সপ্তাহ ধরে আমের ব্যবসা করতে পারেননি।

সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘ফেসবুকের পেইজ খুলে পোস্ট দিলে আমের অর্ডার আসে। আমাদের সবকিছুই অনলাইনের মাধ্যমে। কিন্তু ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় আমের অর্ডার নিতে পারিনি। আমরা যারা অনলাইনে আম কেনাবেচা করি তারা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’

আম বাণিজ্যে শত কোটি টাকার ক্ষতি

আন্দোলন-সংঘাত আর কারফিউ জারির পর আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের অন্তত ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি অ্যাসোসিয়েশন। আম পচে নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে আমের দামে দরপতন হওয়ায় তারা এই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানান। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের সরকারি সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করে এই সংগঠনটি।

কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে প্রায় তিনশ ট্রাকে সাড়ে ৩ হাজার মেট্রিক আম যায় দেশের বিভিন্ন বাজারে। এই আমের মূল্য গড়ে ২৫ কোটি টাকা। আন্দোলনের দশদিনে ২৫০ কোটি টাকার আম বেচাকেনার কথা ছিল। কিন্তু আম পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দাম কমে যাওয়ায় অঙ্ক গিয়ে দাঁড়ায় ১৫০ কোটির ঘরে। ফলে ওই ১০ দিনে চাষি ও ব্যবসায়ীদের ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি বিপণনের কর্মকর্তা মোকাব্বের আলম নাঈম বলেন, ছাত্র আন্দোলনের ফলে আম বেচাকেনা কম হয়েছে। সব কিছু শেষ হয়ে গেলে চাষিরা আবারও ব্যবসা করতে পারবেন এবং তারা তাদের নায্য দাম পাবেন।

/টিপু/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়