ঢাকা     বুধবার   ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ২৭ ১৪৩১

এতিম নুরনাহারের একমাত্র আপনজন ছিলো স্বামী, গুলিতে তাও শেষ

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১২, ৩ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১০:৩০, ৩ আগস্ট ২০২৪
এতিম নুরনাহারের একমাত্র আপনজন ছিলো স্বামী, গুলিতে তাও শেষ

ছেলে রাফি মাহমুদের সাথে নিহত ফয়েজ।

ভালোবেসে এতিম নুরনাহার বেগমকে বিয়ে করেন স্যানিটারি মিস্ত্রি মো. ফয়েজ। তাদের সংসারে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। ঢাকা শহরে একটি ভাড়া বাসায় তাদের সংসার জীবন ভালোই কাটছিল। পৃথিবীতে নুরনাহারের একমাত্র আপনজন ছিলো তার স্বামী। সেই আপনজনকে কেড়ে নেয় কে বা কার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ছুটে আসা দুটি গুলি। যে গুলিতে নিভে যায় ফয়েজের (৩২) তাজা প্রাণ। ফয়েজের মৃত্যুতে অন্ধকারে ঢেকে গেলো সুখের সংসার। নুরনাহারও পৃথিবীতে এখন ফের একা হয়ে গেলো। একমাত্র সন্তান রাফি মাহমুদকে নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।

কোটা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিতে মারা যাওয়া ফয়েজের মা সবুরা বেগম, বাবা আলা উদ্দিন ও স্ত্রী নুরনাহারসহ স্বজনদের সঙ্গে বুধবার (৩১ জুলাই) সকালে মুঠোফোনে কথা বললে কান্না জড়িত কণ্ঠে ঘটনাটি জানায় তারা।

ফয়েজ লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চর আবাবিল ইউনিয়নের পশ্চিম ঝাউডগি গ্রামের কাঠমিস্ত্রি আলা উদ্দিনের ছেলে। তিনি ঢাকায় স্যানিটারি মিস্ত্রি হিসেবে দৈনিক হাজিরায় কাজ করতেন। ২১ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে কাজ শেষে ভাড়া বাসায় ফেরার পথে যাত্রাবাড়ী সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিতে মারা যায় ফয়েজ। 

জানা গেছে, নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারে ফয়েজের জন্ম। এতে অল্প বয়সেই কাজের উদ্দেশ্যে মালদ্বীপ যান তিনি। করোনায় ২০২০ সালে চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। ফের পরিবারের হাল ধরতে চাকরি খুঁজতে তিনি ঢাকায় যান। সেখানে স্যানিটারি মিস্ত্রি (পাইপ ফিটিংস) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরমধ্যেই গাজীপুরের টঙ্গীর বাসিন্দা এতিম নুরনাহারকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। ১৮ মাস আগে তাদের সংসারে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। তার নাম রাফি মাহমুদ। 

ঘটনার পর গুলিবিদ্ধ ফয়েজকে তার পরিচিত স্যানিটারি ঠিকাদার মো. কাশেম হাসপাতালে নিয়েছিলেন। ফোনে কথা হয় তার সঙ্গেও। তিনি বলেন, অ্যাম্বুলেন্স করে প্রথমে ফয়েজকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মাথা ও ঘাড়ে গুলি লাগে। পরে তার মরদেহ লক্ষ্মীপুরের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ফয়েজ খুব শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের ছিলো। দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরি পেতেন। ওই টাকায় স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। 

ফয়েজের মা সবুরা বেগম বলেন, ঘটনার আগমুহূর্তে আমি ফয়েজকে কল দিয়েছি। সে বলছিলো কাজ শেষে বাসায় যাচ্ছে। এরপর বলছিল, ‘মা রাস্তায় অনবরত গুলি হচ্ছে। এখন ফোন রাখো’। কথা শেষ না হতেই বিকট শব্দ শুনতে পায়। এরপর আর তার কথা শুনতে পাইনি। নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। বারবার কল দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। 

এদিকে স্বামীকে হারিয়ে পৃথিবীতে ফের একা হয়ে গেলেন নুরনাহার। শ্বশুর বাড়ির লোকজন গরীব হওয়ায় সেখানেও ঠাই নিতে পারেননি তিনি। স্বামীর মরদেহ দাফন শেষে শিশু রাফিকে বুকে করে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় ফিরতে হয় তাকে। মুঠোফোনে নুরনাহার বলেন, ‘বাবা-মা, ভাই-বোন কেউই নেই। ফয়েজ আমাকে বিয়ে করে আপনজন করে নিয়েছিলো। ফয়েজই পৃথিবীতে আমার একমাত্র আপনজন ছিলো। সে আমার একমাত্র আশ্রয় ছিলো। তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন আমার আর কেউ নেই। কে দেখবে আমাকে ও আমার ছোট্ট রাফিকে। কি দোষ ছিলো ফয়েজের, কে দেবে এর জবাব? আমি এখন বড় একা।’

নুরনাহার আরও বলেন, ‘শ্বশুর বাড়ির লোকজনও গরিব। সেখানে আশ্রয় নিয়েও ফয়েজের মরদেহ দাফন শেষে টঙ্গীতে এক খালার বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছি। খালাও অসুস্থ, তার পরিবারও থাকে অর্ধাহারে অনাহারে। এসব বলেই কান্নায় তিনি ভেঙে পড়েন। এরপর তিনি আর কোনো কথা বলতে পারেননি।’ 

নুরনাহারের খালা বৃদ্ধা হাজেরা বেগম মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি অন্ধ ও অসুস্থ। আমার একমাত্র ছেলেটিও পঙ্গু। আমাদের ওপর আল্লাহ এতো নির্দয় কেন? এতো কষ্ট নিয়ে আমরা কোথায় যাব? নুরনাহার ও তার ছেলেটার দিকে আপনারা সবাই দেখবেন। আমাদের কেউ নেই। এরপর শুধু কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো কথা শোনা যায়নি।’

অন্যদিকে ফয়েজের মা সবুরা বেগম ও বাবা আলাউদ্দিন ছেলের শোকে অনবরত কান্না করছেন। ছেলের মৃত্যুর ৯ দিন পার হলেও তাদের কান্না থামেনি। ফয়েজ ছিলো তাদের তিন ছেলে-মেয়ের সবার বড়। তার কবরের পাশে বার বার ছুটে যাচ্ছেন মা সবুরা। আর ছেলের শোকে হাউমাউ করে কাঁদছেন। প্রতিবেশীরাও তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। 

ফয়েজের বাবা আলাউদ্দিন বলেন, ‘ফয়েজ একজন শ্রমিক ছিলো। কোনো ধরণের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলো না। কি দোষে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। সেতো আর ফিরে আসবে না। তার স্ত্রী-সন্তানকে কে দেখবে। বউটাও এতিম। আমি চট্টগ্রাম পোর্টে চাকরি করতাম। সেনা সরকারের সময় এক আন্দোলনে চাকরি হারিয়েছি। এবার আরেক আন্দোলনে আমার ছেলেকে হারালাম। কে বা কার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ছোঁড়া দুটি গুলি আমার ছেলেটাকে শেষ করে দিলো। আমি ফয়েজ হত্যার বিচার কার কাছে চাইবো?’ 

প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ২১ জুলাই সন্ধ্যায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন ফয়েজ। আহত অবস্থায় ফয়েজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বিপুল সংখ্যক মুসল্লির অংশগ্রহণে ২২ জুলাই জানাজা শেষে ফয়েজের মরদেহ পশ্চিম ঝাউডগি গ্রামের বাড়ির পাশে দাফন করা হয়।

জাহাঙ্গীর/ইমন


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়