আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারাতে বসেছেন টুটুল ও জিহাদ
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে চোখ হারাতে বসেছেন সিরাজগঞ্জের আমিনুর রহমান টুটুল (২৩) ও জুবায়ের হাসান জিহাদ (২২)। গুলিবিদ্ধ দুই শিক্ষার্থীর পরিবার টাকার অভাবে তাদের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এজন্য সকলের কাছে চিকিৎসার সহযোগিতা চাচ্ছেন তারা।
গুলিবিদ্ধ আমিনুর রহমান টুটুল জেলার তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের কুসুম্বী গ্রামের কৃষক আলম হোসেনের ছেলে । তিনি সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী।
জুবায়ের হাসান জিহাদ জেলার কামারখন্দ উপজেলার হায়দাপুর গ্রামের মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে । তিনি সরকারি হাজী কোরপ আলী মেমোরিয়াল কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী।
মায়ের সঙ্গে জিহাদ
জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৬ জুলাই সিরাজগঞ্জ ইসলামিয়া কলেজ মাঠে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এসময় ৩২টি রাবার বুলেটের আঘাত লাগে আমিনুর রহমান টুটুলের শরীরে। ছোটাছুটির একপর্যায়ে বাঁ চোখে গুলি লাগে তার। পরে সহপাঠীরা তাকে সিরাজগঞ্জ শহরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করে। একই দিনে শহরের রেলগেট এলাকায় রাবার বুলেট জুবায়ের হাসান জিহাদের চোখে লাগে। পরে তার বন্ধুরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার অবস্থা ভালো না দেখে চিকিৎসকেরা তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়।
শিক্ষার্থী আমিনুর রহমান টুটুল বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আমি ইসলামিয়া কলেজ মাঠে অংশগ্রহণ করি। সেখানে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট আমার পিঠে ও চোখে লাগে। এতে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আমার সহপাঠিরা আমাকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করে। পরে আমার বন্ধুদের সহযোগিতায় ১৮ জুলাই ঢাকা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে একটু সুস্থ আছি। তবে আমার চোখে অপারেশন করতে হবে ভারতে গিয়ে। কিন্তু আমরা এ মুহূর্তে আর্থিক সংকটে আছি। চোখের আলো ফেরাতে উন্নত চিকিৎসা পেতে তিনি সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন।
শিক্ষার্থী জুবায়ের হাসান জিহাদ বলেন, ছাত্র আন্দোলনের মিছিল নিয়ে সিরাজগঞ্জে ইসলামিয়া কলেজ মাঠ থেকে বের হয়ে রেলগেট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ লাঠিচার্জ করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ছোড়ে। একপর্যায় একটা ছোড়া গুলি এসে আমার বাম চোখে লাগে। আমার বন্ধুরা হাসপাতলে নিয়ে যায়। অবস্থা ভালো না দেখে চিকিৎসকরা ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সেই অপারেশনের পর থেকে বাম চোখে দেখতে পাই না। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা আমাকে বলেছে এখনো তিনটা অপারেশন করতে হবে। কিন্তু চোখে দেখতে পাব কিনা বলতে পারছেন না। আমি চাই আমার চোখের দৃষ্টি ফিরে আসুক। এখন পর্যন্ত আমার এটাই চাওয়া, আর কিছু চাওয়ার নেই।
বাবা-মায়ের সঙ্গে টুটুল
সহপাঠী জুয়েল রানা, সামিউল হাসান নীরব, রুকাইয়াসহ কয়েকজন বলেন, ইসলামিয়া কলেজ থেকে একটা মিছিল বের করি তখন পুলিশের বাধার সম্মুখীন হই। সেখানে পুলিশ আমাদের ওপর গুলি ছোড়ে। এক পর্যায়ে টুটুলের শরীরে বেশকিছু গুলি লাগে। একই সঙ্গে গুলি জুবায়েরের বাম চোখেও লাগে। তখন আমরা টুটুল ও জিহাদকে এম.এ মতিন চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে চিকিৎসকেরা তাদের ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, টুটুল ও জিহাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো না। চিকিৎসা করানোর মতো পরিস্থিতি নেই তাদের। এজন্য তাদের চিকিৎসার ভার যেন সরকার নেয় এটাই আমাদের চাওয়া। আমরা সরকারে কাছে এটাই আবেদন করছি।
টুটুলের বাবা আলম হোসেন জানান, আমি হাঁস পালন করে কোন রকম সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু আমার একমাত্র ছেলেকে কীভাবে চিকিৎসা করাবো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তাও ছেলের চিকিৎসার জন্য হাঁস বিক্রি ও ধারদেনা করে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার টাকা শেষ করেছি। আমার হাতে আর কোনো টাকা-পয়সা নেই। এখনো তার চোখের অপারেশন বাকি। বিত্তবান ব্যক্তি ও সরকারের কাছে ছেলের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতার অনুরোধ জানান তিনি।
টুটুলের মা হামেছা খাতুন বলেন, আমার সন্তান বাঁ চোখ দিয়ে দেখতে পারছে না। ছেলে আহত হওয়ার পর ৬ দিন হাসপাতালে থাকলেও টাকার অভাবে চিকিৎসা শেষ না করে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। আমাদের কোন জমি-জমা নাই যে বিক্রি করে সন্তানের চিকিৎসা করাবো। এজন্য ছেলেকে যেন কেউ কিছু একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে দেয়- তিনি এ দাবি জানিয়েছেন।
জিহাদের মা হাসি বেগম বলেন, ৫ মাস বয়সে জিহাদের বাবা মারা গেছেন। আমার তিন মেয়ে ও এক ছেলে। এই ছেলেকে নিয়েই খুব কষ্টে জীবনযাপন করছি। সে এবার এইচএসসি পরীরক্ষা দিচ্ছে। আশা ছিল রেজাল্ট করলে ঢাকায় ভর্তি করাবো। পড়াশোনা করে একটা চাকরি করলে আমার দুঃখ কেটে যাবে। ছেলে আন্দোলনে গিয়ে চোখ হারালো।
তিনি আরও বলেন, ছেলের চোখের চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য নেই। আরো তিনটা অপারেশন করাতে হবে। এতে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হবে। সরকার যদি আমার ছেলের পাশে দাঁড়ায় তাহলে হয়তো সে চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবে। ছেলের এ অবস্থায় সরকারি চাকরি পাবে কিনা সন্দেহ। তারা যদি কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমার দুঃখ ঘুচবে। না হয় সারাজীবন চোখ হারানো ছেলেকে নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিরাজগঞ্জের সমন্বয়ক সেজান ও তাড়াশের মেহেদী হাসান নিরব বলেন, আমি কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং দেশবাসীর কাছে টুটুল ও জিহাদের আর্থিক সহযোগিতা করা অনুরোধ জানাচ্ছি। সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, তিনি যেন একটি সরকারি চাকরি পান। এছাড়াও আমরা ছাত্রসমাজ তাদের পাশে আছি এবং থাকব।
অদিত্য/টিপু