ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মালয়েশিয়ায় ৩ মৃত্যু

‘সালামের লগে আমার সুখ, আশা-ভরসা সব শেষ হইয়া গেলো’ 

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৪, ১৪ অক্টোবর ২০২৪   আপডেট: ২০:২০, ১৪ অক্টোবর ২০২৪
‘সালামের লগে আমার সুখ, আশা-ভরসা সব শেষ হইয়া গেলো’ 

জব্বার আলী, আবু তাহের ও আবদুস সালাম

‌‘সালামের বয়স যহন দুই মাস, তহন ওর বাবার লগে আমার ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছিলো। এরপর এই পোলাডারে লইয়া আমি বাঁইচ্ছা আছিলাম। বাড়ির সবাই আমারে দ্বিতীয়বার বিয়া দিতে চাইছিল। পোলাডার মুহের দিক চাইয়া বিয়া করি নাই। সালাম আছিল আমার সব আশা ভরসা। আগুনে পুইড়া আমার সালাম শেষ, সালামের লগে আমার সুখ, আশা-ভরসা সব শেষ হইয়া গেলো।’ 

এভাবেই বিলাপ করে কথাগুলো বলছিলেন মালয়েশিয়ায় কারখানায় বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া শ্রমিক আবদুস সালামের মা তাছলিমা বেগম।

আরো পড়ুন:

সোমবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রমজানবেগ গ্রামে নিহত সালাম এবং আবু তাহেরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্বাজনরা নির্বিকার। ঘরের বাহিরে বসে কাঁদছিলেন সালামের মা। একপাশে বসে ছিলেন সালামের নানি এবং একই দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে গত শনিবার ভোররাতে মারা যাওয়া আবু তাহেরের মা খায়রুন নেছা। এক বাড়িতে দুটি মৃত্যুতে পুরো পরিবারটি ভেঙে পড়েছে। ঘরের ভেতরে নির্বাক হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন নিহত আবু তাহেরের স্ত্রী মাকসুদা বেগম। বাড়িতে স্বজনরা এসে বারবার তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তাদের। 

নিহত আবদুস সালাম (২৪) নারায়ণগঞ্জের মহিউদ্দিনের ছেলে। বাবা-মায়ের বিয়ে বিচ্ছেদের পর মা তাছলিমা বেগমের সঙ্গে নানার বাড়ি মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রমজানবেগ গ্রামে থাকতেন তিনি। দেড় বছর আগে ধার-দেনা করে মালয়েশিয়া যান সালাম। সেখানে মামা তাহের আলীর সঙ্গেই থাকতেন সালাম। কাজ করতেন জোহর রাজ্যের ইস্কান্দার পুতেরের গেলাং পাতার এসআইএলসি শিল্প এলাকায় রাসায়নিক কারখানায়। 

গত ১০ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে কাজ করার সময় এসআইএলসি কারখানায় বিষ্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে সালাম, সালামের মামাসহ তিন বাংলাদেশি শ্রমিক দগ্ধ হন। তাদের শরীরে অধিকাংশ পুড়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শনিবার সালামের মামা আবু তাহের (৩২) ও গতকাল রোববার বিকেল ৫টার মারা যান সালাম। একই ঘটনায় গত শুক্রবার মারা যান একই গ্রামের রাজ্জাক ভূঁইয়ার ছেলে জব্বার আলীও (৪২)।

সালামের মা তাছলিমা বেগম বলেন, ‘পোলায় কইত বিদেশ যাইবো, আমাগো সব কষ্ট শেষ অইব। নিজেরা আলাদা জায়গা কিনবো, বাড়ি করবো। ওই বাড়িতে আমারে রাখবো। আমারতো সব শেষ হইয়া গেলো। পোলাডার শরীরে আগুন লাগার পর বুঝতে পারছিল হয়তো অয় আর বাঁচবো না। আমার লগে আর একটা কথাও কয় নাই অয়। ওর লগে যে বাংলাদেশিরা থাকতো, তাগো কইছিল, আমারে ফোন দিয়া কইস আমার মায় যেন আমারে মাফ কইরা দেয়।’

আবু তাহেরের মা খায়রুন নেছার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘কত মানুষের বাড়িতে, কত দুর্ঘটনার কথা হুনতাম। কোনোদিনও ভাবি নাই আমাগো বাড়িতে এমন দুর্ঘটনা আইবো। আমার পোলা আর নাতি আগুনে পুইড়া মইরা যাইবো।’

প্রশাসনের কাছে খায়রুন নেছা তার ছেলে এবং নাতির লাশ এনে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বলেন, ‘পোলা আর নাতি জীবিত তো আর ফিরা আইবো না। বিদেশের মাটিতেও ওগো লাশ পইড়া আছে। আমাগো দেশের সরকার লাশগুলো দ্রুত আনোনের ব্যবস্থা কইরা দেওক।’ 

দুর্ঘটনায় নিহত জব্বার আলীর বাড়িতেও সবাই স্তব্ধ। জব্বার আলী রমজানবেগ গ্রামের আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়ার ছেলে।

জব্বার আলীর বাবা আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রতিদিন ছেলে আমাকে ফোন করতো। আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতো। গত বুধবার গভীর রাতে আমাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখে ফোন করেছিল। আমি জব্বারকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, আল্লাহ যার হায়াত যতক্ষণ রেখেছেন সে ততক্ষণ বেঁচে থাকবেন। বৃহস্পতিবার সকালে জব্বার ফোন দেয়নি। আমি ফোনের আশায় থেকে নিজেই ফোন করেছিলাম। সে আর ফোন ধরেনি। দুপুরে জানতে পারলাম আমার ছেলের শরীরে আগুন লেগেছে। পরদিন শুক্রবার সে মারা গেছে।’ 

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিফা খান বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করা হয়েছে। তাদের লাশ আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নেওয়া হবে। পরিবারগুলোর পাশে থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে।’

মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফাতেমা তুল জান্নাত বলেন, ‘মরদেহগুলো দ্রুত কিভাবে দেশে আনা যায় সে বিষয়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। নিহতদের পরিবারগুলোর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা করা যায় তার সবটুকু করা হবে।’

মাসুদ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়