ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মিছিলে গিয়েছিলেন তিন ভাই, ফেরা হয়নি সাকিবের

শিরিন সুলতানা কেয়া, রাজশাহী  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১২, ২৬ নভেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২৩:০৪, ২৭ নভেম্বর ২০২৪
মিছিলে গিয়েছিলেন তিন ভাই, ফেরা হয়নি সাকিবের

সাকিব আনজুম

এই নভেম্বরে ফিনল্যান্ডে যাওয়ার কথা ছিল সাকিব আনজুমের (২৮)। তার আগে জুলাইয়ে যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হলো, তখন ঘরে বসে থাকতে পারেননি তিনি। নিজে আন্দোলনে গেছেন, সঙ্গে নিয়েছেন ছোট দুই ভাইকেও। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর ছোট দুই ভাই বাড়িতে ফিরলেও সাকিব আনজুমের আর ফেরা হয়নি।

শেখ হাসিনা দেশত্যাগের কিছুক্ষণ আগে রাজশাহী নগরের শাহ মখদুম কলেজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাকিব। তিনি রাজশাহী নগরীর রানীনগর এলাকার মাইনুল ইসলামের ছেলে। 

আরো পড়ুন:

আরডিএ মার্কেটের কসমেটিকস ব্যবসায়ী মাইনুল ছেলেকে পড়িয়েছেন রাজশাহীর বেসরকারি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই বছর আগে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন সাকিব। এর পর যোগ দিয়েছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।

মা, বাবা আর স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে এ নভেম্বরেই ফিনল্যান্ডে যাওয়ার কথা ছিল সাকিবের। সেখানে পড়শোনার পাশাপাশি উপার্জন করে সংসারের হাল ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। সেসবের কিছুই হয়নি। 

গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনলে মা অসুস্থ হয়ে পড়বেন, এটা ভেবে মাকে খবর দিতে দেননি সাকিব। এখন ছেলে হারানোর শোকে প্রতিনিয়ত অসুস্থ হয়ে পড়েন মা রোকেয়া বেগম। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে নির্বাক স্ত্রী নিশাত সালসাবিনও।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের আগে রাজশাহীতে কী হয়েছিল, তার বিবরণ পাওয়ায় যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীবের বর্ণনায়। উপাচার্য হওয়ার আগে তিনি নিজেও রাজপথে ছিলেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ৫ আগস্ট সকালে ছাত্র-জনতার ভিড়ে সাকিব আনজুম হাত মিলিয়েছিলেন অধ্যাপক নকীবের সঙ্গে। অধ্যাপক নতীব তখন তার নামও জানতেন না। বিকেলে দেখতে পান সকালে সাক্ষাৎ হওয়া সেই ছেলের লাশ।

উপাচার্য সালেহ হাসান নকীবের বর্ণনা অনুযায়ী, বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তারা যখন মিছিল নিয়ে শাহ মাখদুম কলেজের কাছে, তখন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা গুলি করা শুরু করেন। সেই সঙ্গে একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণ হয়। গুলির মুখে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। 

শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বেলা সাড়ে ৩টার দিকে অধ্যাপক নকীব জানতে পারেন, শাহ মাখদুম কলেজের কাছে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ পড়ে আছে। তারা আবার যান সেখানে। কলেজের কাছাকাছি গিয়ে দেখেন, ভ্যানের ওপর চাটাইয়ে মোড়ানো একটি মরদেহ। অধ্যাপক নকীব চাটাই খুলে দেখেন, সকালে হাত মেলানো সেই ছেলেটি— শহিদ সাকিব আনজুম।

কেমন ছিল সাকিবের শেষ সময়টুকু? সে গল্পও অধ্যাপক নকীব সম্প্রতি শুনেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অ্যানির মুখে। মৃত্যুর সময় অপরিচিত অ্যানিই ছিলেন সাকিব আনজুমের পাশে। 

অ্যানির বর্ণনা অনুযায়ী, সাকিব আনজুমের কাঁধের একটু নিচে গুলি লাগে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। তখন আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তার ওপর কিরিচ নিয়ে চড়াও হয়। পরে গুরুতর আহত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় সাকিবকে কলেজের পাশের একটি বাসার ভেতর নেওয়া হয়। সাকিবের শেষ ঘণ্টাখানেক সেখানেই কেটেছে। 

অ্যানি ফোন করে পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলেন। অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে ফোন করেছেন। কোনো সাহায্য পাননি। একপর্যায়ে অ্যানি সাকিবকে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে চেয়েছেন। সাকিবের উত্তর ছিল, ‘‘মা অসুস্থ, আমার এই অবস্থা জানলে সহ্য করতে পারবেন না।’’ 

ওই বাসায় থাকা অবস্থায় সাকিবের রক্তপাত কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছিল না। অচেনা অ্যানি মৃত্যুপথযাত্রী সাকিব আনজুমের রক্ত পড়া বন্ধ করতে তার নিজের পরনের কাপড় ব্যবহার করেন। সেই রক্তে ভেজা হিজাব অ্যানি এখনও সেভাবেই রেখে দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে অ্যানি সাকিবকে কালেমা পড়ান। সচেতন রাখার চেষ্টা করেন। একটা সময় সাকিব আনজুম ‘শহিদ সাকিব আনজুম’ হয়ে যান। সেই খবর দুপুর দেড়টায় খবর পান বাবা মাইনুল ইসলাম।

সোমবার (২৫ নভেম্বর) সকালে রানীনগরে সাকিব আনজুমের বাসায় কথা হয় তার বাবা মাইনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘যারা শহিদ হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত আর কেউ নয়।’’

মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘দেশে দুর্নীতি হচ্ছিল, মেধাবীদের চাকরি ছিল না। জালেম সরকার জনগণের মাথার ওপর বসে ছিল। পরিবর্তনের জন্য আমার তিন ছেলেই গিয়েছিল মিছিলে। ছোট দুই ছেলে দেশ স্বাধীন করে এসেছে, আমার বড় ছেলেটাই আসেনি।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘এই দেশের জন্য আমার ছেলে জীবন দিয়েছে। আমি চাই, দেশটা ভালো হোক। ভালো লোকের শাসন চাই। কোনো জালেমের শাসন আর এই বাংলাদেশে চাই না।’’

সাকিব আনজুম হত্যার ঘটনায় গত ২৩ আগস্ট বোয়ালিয়া থানায় মামলা করেন মাইনুল ইসলাম। এতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারসহ ৪২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আরও ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে মামলায়। ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছিল সাকিব আনজুমের মরদেহ।

৭২ দিন পর ১৬ অক্টোবর কবর থেকে তুলে সাবিকের দেহাবশেষের ময়না তদন্ত করা হয়। সেদিনই দেহাবশেষ আবার কবরে রাখা করা হয়।

মাইনুল ইসলাম ছেলে হত্যার বিচার চান। তবে এখনো বিচারব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কিত তিনি। 

মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘এখনো বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফেরেনি। আমিও আস্থা রাখতে পারিনি। আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার যেন হয়, এটাই আমার চাওয়া। কারণ, আমাকে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু আমি অহেতুক কাউকে আসামি করিনি। যারা জড়িত, খুঁজে খুঁজে আমি তাদেরকেই আসামি করেছি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে শুধু আমার মামলাটিতেই প্রকৃত জড়িত ব্যক্তিদের আসামি করেছি। এদের শাস্তি আমি দেখতে চাই।’’

‘‘কিন্তু পুলিশ তো আসামি ধরতে পারছে না। মামলা করার পর দুই-একটা আসামি ধরেছে। তারপর আর খবর নেই,’’ আক্ষেপের সঙ্গে বলেন সাকিব আনজুমের বাবা মাইনুল ইসলাম।

রাজশাহীতে যোগ দিয়েই গত ৩ নভেম্বর সাকিব আনজুমের বাড়ি গিয়ে তার পরিবারের খোঁজ নেন নতুন জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার। এ সময় তিনি সাকিব হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করার আশ্বাস দেন। জেলা প্রশাসন যে কোনো প্রয়োজনে সাকিবের পরিবারের পাশে থাকবে বলেও তুলে ধরেন তিনি।

ঢাকা/রফিক/রাসেল

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়