ঢাকা     শনিবার   ২২ মার্চ ২০২৫ ||  চৈত্র ৯ ১৪৩১

জুলাই বিপ্লবে গুলিতে মৃত্যু, দেখানো হয় সড়ক দুর্ঘটনা

রাজশাহী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৮:২০, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
জুলাই বিপ্লবে গুলিতে মৃত্যু, দেখানো হয় সড়ক দুর্ঘটনা

দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা, ‘শহিদ মিনারুল’

বাড়ির সামনে দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা, ‘শহিদ মিনারুল’। প্রতিবেশী কয়েকজন কিশোর এগিয়ে এসে বলল, ‘এটা আমরাই লিখেছি।’ প্রতিবেশীরাও বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জে গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন পোশাক শ্রমিক মিনারুল ইসলাম (২৭)। কিন্তু তাকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত দেখানোর চেষ্টা চলছে। 

পরিবার বলছে, মৃত্যুর পরদিন রাজশাহী নগরের গুড়িপাড়া-পুরাপাড়ায় বাড়িতে মিনারুলের মৃতদেহ আনা হয়। এ সময় সেখানে আসেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রজব আলী। তিনি পরিবারকে চাপ দিতে থাকেন ‘মিনারুল গুলিতে নিহত হয়েছে’ এ কথা না বলতে। এ সময় রাজব আলী বলেন, ‘‘সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলে লাশ দাফন করতে হবে।’’

প্রতাপশালী এই আওয়ামী লীগ নেতার মুখের ওপর তখন কথা বলতে পারেননি নিহত মিনারুলের দুই ভাই নাজমুল এবং মো. সোহেল। ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মিনারুলের মৃত্যু’ সনদে লিখে দেন রজব আলী। 

আরো পড়ুন:

মিনারুল ইসলামের ভাই মো. সোহেল জানান, ৫ আগস্টের আগে আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা কম দেখাতে কাউন্সিলর রজব আলী এবং তার ভাই যুবলীগ নেতা নাহিদ আক্তার নাহান তাদের বলতেই দেননি যে, মিনারুল মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। নানামুখী চাপে রেখেছিলেন তারা। আওয়ামী সরকারের পতনের পর পালিয়ে যান নাহান। ৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাতে গিয়ে বিজিবির হাতে গ্রেপ্তার হন কাউন্সিলর রজব আলী।

এরপর গত ৩ সেপ্টেম্বর মিনারুলের আরেক ভাই নাজমুল বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক এমপি শামীম ওসমান, গোলাম দস্তগীর গাজী, মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। তালিকায় রজব আলী, নাহিদ আক্তার নাহান ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা জাকির হোসেনসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের স্থানীয় যেসব নেতাকর্মী পরিবারটিকে চাপে রেখেছিল তাদের আসামি করা হয়েছে। 

পরিবারের অভিযোগ এখনও আসামিরা মিনারুলের মৃত্যুকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হিসেবেই মিনারুল ইসলাম তালিকাভুক্ত হয়েছেন জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য কাগজপত্রে। সম্প্রতি তার পরিবার জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা সহায়তাও পেয়েছে।

মিনারুল বিবাহিত ছিলেন। মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী শম্পা খাতুন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী হারানোর পর পুত্রসন্তানের মা হয়েছেন শম্পা। স্বামীর সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছেন মিনহাজুল ইসলাম। শিশুটির বয়স এখন ৩ মাস। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন শম্পাকে চার লাখ এবং মিনারুলের মা ডলি বেগমকে এক লাখ টাকা দিয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হন মিনারুল ইসলাম


তারপরও কেন এই বিতর্ক?

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক এবং একটি টেলিভিশনে মিনারুলের মৃত্যু নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ দুটিতে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মিনারুলকে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ হিসেবে দেখানো হয়েছে এবং শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে টাকা তুলে নিয়েছে পরিবার। ওই সংবাদে রজব আলীর করে দেওয়া মৃত্যু সনদের ওপরেই জোর দেওয়া হয়, যেখানে মিনারুলের মৃত্যুর কারণ লেখা হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এই সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করছেন।

যেভাবে মৃত্যু

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী রোডের আল-আমিন নগর এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় মিনারুলের পেটের নিচে গুলি লাগে। আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে শহরের খানপুরে ৩০০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন।

গত ২২ জুলাই দৈনিক ‘মানবজমিন’র প্রথম পাতায় ‘নারায়ণগঞ্জে দুদিনে নিহত ১৩’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে আন্দোলনে নিহত হিসেবে মিনারুলের নাম ছিল। ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি রাজধানীর হাতিরপুলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘পোশাক খাতের চলমান পরিস্থিতি ও করণীয় এবং গণঅভ্যুত্থানে নিহত পোশাক শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ’ শিরোনামে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জের ১৪ জনের নাম প্রকাশ করা হয়, এদের একজন মিনারুল।

‘নারায়ণগঞ্জের কাগজ’ ২৬ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে নিহতের তালিকায় নারায়ণগঞ্জের তথ্য যুক্ত করা হচ্ছে। ওই সময় পর্যন্ত নিহতের তালিকায় নারায়ণগঞ্জের ২৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকার ৩৫ নাম্বারে লেখা আছে, ‘মিনারুল ইসলাম, পিতা- মৃত এনামুল। গুডীপাড়ি, রাজশাহী।’ 

এ ছাড়াও ১০ অক্টোবর ‘প্রথম আলো’র অনলাইনে ‘নারায়ণগঞ্জে অভ্যুত্থানের দিনলিপি/যেভাবে ছড়িয়ে গেল দ্রোহের আগুন’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদে নিহতদের তালিকা প্রকাশ হয়। এর ৩৪ নাম্বারে মিনারুলের নাম ও ঠিকানা প্রকাশিত হয়েছে। 

সরেজমিনে যা জানা গেল

বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী নগরের গুড়িপাড়া পুরাপাড়া মহল্লায় মিনারুলের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় ডলি বেগম এবং  তার রিকশাচালক দুই ভাই নাজমুল ও সোহেলের সঙ্গে। আন্দোলনে নিহত ভাইকে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে প্রচার করা হলে তারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। একজন শহীদকে নিয়ে এমন অপপ্রচারে ভীষণ কষ্টও পাচ্ছেন বলে জানান নাজমুল ও সোহেল। 

ডলি বেগম বলেন, ‘‘১২ বছর মিনারুল নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় কাজ করে। ২০ তারিখ (জুলাই) তিনজনকে নিয়ে ও বাজার করার জন্য বাইর হইছিল। আন্দোলনের মাঝে পড়ে তলপেটে গুলি লাগে। কারখানার অন্যরা তখন ফোন করে আমাদের জানায়।’’

‘‘লাশ আনার পর রজব কাউন্সিলর আমাদের গুলি লাগার কথা বলতে নিষেধ করে দেয়। ওরা সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলতে বলে। এরপর তো রজব কাউন্সিলর তার অফিস থেকে যে সার্টিফিকেট দিছে সেখানেও সড়ক দুর্ঘটনা লিখে দিছে।’’ বলেন ডলি বেগম। 

সোহেল এ সময় এই প্রতিবেদককে একটি ভিডিও দেখান। ভিডিওতে দেখা যায়, ট্রলির ওপর মিনারুলের নিথর দেহ পড়ে আছে। তার তলপেট থেকে ব্যান্ডেজ খোলা হচ্ছে। সেখানে প্রায় আধাইঞ্চি ব্যাসার্ধের একটি গভীর ক্ষত। এটি বুলেটের ক্ষত বলে দাবি পরিবারের। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য পাওয়া গেছে। তারাও বলছেন, মিনারুলের মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় নয়, গুলিতে হয়েছে। 

মিনারুলের লাশ গোসল করিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘সড়ক দুর্ঘটনা হলে তো শরীরের অন্য স্থানেও আঘাতের চিহ্ন দেখা যাবে। কিন্তু কোথাও কোনো আঘাত আমি দেখিনি। গোসলের সময় লাশ আমি উল্টে-পাল্টে দেখেছি। শুধু তলপেটে একটা গভীর ক্ষত ছিল। সেটা বুলেট ঢুকে যাওয়ার ক্ষত বলেই আমি মনে করি।’’

স্থানীয় বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘‘লাশ আনার পর থেকে আওয়ামী সরকারের পতনের সময় পর্যন্ত রজব, তার ভাই নাহান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পরিবারটিকে চাপে রেখেছিল। তারা বলতেই দেয়নি যে মিনারুল আন্দোলনে নিহত হয়েছে।’’

মহল্লার প্রায় অর্ধশতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু এই প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন। তাদের প্রত্যেকের ভাষ্য, মিনারুল আন্দোলনে গুলিতে নিহত হলেও সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। একজন শহীদের মৃত্যুকে এভাবে ভিন্ন খাতে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় তাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ এবং বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।  

মা ডলি বেগমের কান্না থামছে না


 বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জি কে এম মেশকাত চৌধুরী মিশু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘জুলাই ফাউন্ডেশন ক্রস চেক করে টাকা দিয়েছে। অনেকে এখনও টাকা পায়নি তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কেউ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা অবশ্যই মিনারুল ইসলামের পরিবারের পাশে দাঁড়াব। কারণ, যে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, তাদের এজেন্ট এখনও রয়ে গেছে। তারা আমাদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। যারা এসব অপপ্রচার করছে, তারা নিশ্চয়ই কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।’’

সুষ্ঠু তদন্ত দাবি

মিনারুলের মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জে তার লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি। ময়নাতদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে কাউন্সিলর রজব আলী লাশ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ পরিবারের। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য দ্রুত ময়নাতদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, ময়নাতদন্ত করলেই মৃত্যুর সঠিক কারণ সামনে আসবে।

রজব আলী গ্রেপ্তার থাকায় তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে কথা বলা যায়নি। নাহিদ আক্তার নাহান আত্মগোপনে রয়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

১ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সচিব সামশুল কবিরের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি দুইমাস হলো এখানে এসেছি। কীভাবে মৃত্যুসনদে সড়ক দুর্ঘটনা লেখা হয়েছে বলতে পারব না।’’

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, ‘‘আমরা মামলাটি তদন্ত করছি। সময় লাগলে লাগুক, তদন্ত সঠিক হবে। যেটা সঠিক, সেটাই বেরিয়ে আসবে।’’

কেয়া/তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়