আলোর উৎসবে সম্প্রীতির গল্প
সারা দেশে ভালোবাসা ও মানবিকতার বার্তায় বড়দিন
নিউজ ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম
ডিসেম্বরের শীতল সকালে দেশের নানা প্রান্তে যখন ঘন্টার ধ্বনি ভেসে আসে, তখন আলো, প্রার্থনা আর শিশুর হাসিতে মুখর হয়ে ওঠে খ্রিষ্টান পল্লীগুলো। যিশুখ্রীষ্টের জন্মদিন—বড়দিন শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি শান্তি, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির এক সর্বজনীন বার্তা। এ বছরও সেই বার্তাই ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে প্রত্যন্ত জনপদে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই গীর্জাগুলোতে শুরু হয় বিশেষ প্রার্থনা। কোথাও শিশুদের হাতে রঙিন বেলুন, কোথাও আবার কেক কাটার প্রস্তুতি। গীর্জার দেয়ালজুড়ে ঝলমলে আলো, ক্রিসমাস ট্রি আর তারার সাজে অন্য রকম এক আনন্দের আবেশ।
শিশুদের হাসিতে ঝালকাঠির রাজাবাড়িয়া
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার রাজাবাড়িয়া গ্রাম; জেলার একমাত্র খ্রিষ্টান পল্লী। এখানকার চার্চে বড়দিনের সকালে শিশুদের সঙ্গে কেক কেটে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করেন জেলা প্রশাসক মো. মমিন উদ্দিন। তার উপস্থিতিতে শিশুদের উচ্ছ্বাস যেন আরো বেড়ে যায়। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতি এই উৎসবে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা; রাষ্ট্র ও ধর্মীয় সম্প্রীতির এক নীরব বার্তা।
চার্চ সভাপতি পলাশ রবিন গোমেজ বলেন, “আমরা অল্প কয়েকটি পরিবার হলেও সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকি। বড়দিন সেই মিলনের আনন্দকে আরো গভীর করে।”
কুড়িগ্রামে অস্থায়ী চার্চে স্থায়ী আনন্দ
কুড়িগ্রাম সদরের রিভার ভিউ মোড় এলাকায় অস্থায়ী চার্চে দুপুরের আলোয় বসে প্রার্থনায় মগ্ন হন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা। ধর্মীয় সঙ্গীত, স্বাস্থ্য পাঠ আর কেক কাটার মধ্য দিয়ে পালন করা হয় বড়দিন। বাক্য পরিচর্যক ইমরান সরকার বলেন, “বড়দিন মানুষকে ভালোবাসা ও মানবিকতার পথে আহ্বান জানায়; এই আহ্বানই তাদের শক্তি।”
শেরপুরে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের ছোঁয়া
শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার বারোমারি সাধু লিওর ধর্মপল্লীতে বড়দিন মানেই বিশাল আয়োজন। আগের রাতের প্রার্থনা থেকে শুরু করে সকালে কেক কাটা, ধর্মীয় আলোচনা ও সংকীর্তন; সব মিলিয়ে দিনভর উৎসব।
পাল পুরোহিত ফাদার তরুণ বনোয়ারির কণ্ঠে ধরা পড়ে বড়দিনের মূল দর্শন; মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা।
গোপালগঞ্জে মধ্যরাতের কেক ও আলো
ঘড়ির কাঁটা যখন রাত পেরিয়ে যায়, তখন গোপালগঞ্জের ঘোষেরচর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে ‘হ্যাপি বার্থডে’ সুরে কেক কাটে শিশুরা। জেলার ১৬৯টি গীর্জায় একযোগে প্রার্থনা ও ধর্মীয় আয়োজন চলে। রঙিন আলো, তারকা আর ক্রিসমাস ট্রিতে সাজানো গীর্জা ও খ্রিষ্টান পল্লীগুলো যেন আনন্দের শহরে রূপ নেয়।
গাইবান্ধায় আদিবাসী সংস্কৃতির ছোঁয়া
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৭ ইউনিয়নের ৫২টি গীর্জায় বড়দিন পালিত হয় স্থানীয় সংস্কৃতি আর ধর্মীয় আচার মিলিয়ে। আদমপুর লুথারেণ গির্জায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কেক কাটা হয়।
খ্রিষ্টান নেত্রী এমেলি হেম্ব্রম বলেন, “এই দিনের জন্য শিশুরা সারা বছর অপেক্ষা করে। আজ আমরা দেশের মঙ্গল কামনা করেছি।”
নিরাপত্তা ও সম্প্রীতি
বড়দিন নির্বিঘ্ন করতে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল তৎপর। গীর্জা পরিদর্শন, মোবাইল টিম ও সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হয় শান্তিপূর্ণ উদযাপন।
বড়দিন শেষে আলো নিভে যায়, সঙ্গীত থামে। কিন্তু, থেকে যায় যিশুখ্রীষ্টের সেই চিরন্তন শিক্ষা; ভালোবাসা, ক্ষমা আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই বার্তাই বড়দিনকে করে তোলে সার্বজনীন, আর বাংলাদেশকে করে তোলে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিনিধিরা]
ঢাকা/অলোক সাহা/বাদশাহ্ সৈকত/তারিকুল ইসলাম/বাদল সাহা/মাসুম লুমেন/জান্নাত