নীরবেই ফুটে গেলো কৃষ্ণচূড়া
অরিত্র দাস || রাইজিংবিডি.কম
বুদ্ধদেব গুহ তার ‘সবিনয় নিবেদন’ গ্রন্থে বলেছিলেন, বসন্ত প্রেমের ঋতু আর গ্রীষ্ম কামের। তাঁর এই কথার উপর ভিত্তি করে আমার কাছে মনে হয়, কৃষ্ণচূড়া প্রেম এবং কাম দুটোকেই অত্যন্ত প্রলুব্ধ করে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, বসন্তের শেষ দিকে ও গ্রীষ্মের উত্তপ্ত রৌদ্রোজ্জ্বল প্রকৃতিতে ধরা দেয় রক্তাক্ত কৃষ্ণচূড়া। আর তাতে পালের হাওয়া দেয় যেন বৈশাখ।
প্রতিবছর এ সময়ে কৃষ্ণচূড়া ফুটে গাছে গাছে, এবারও ফুটেছে। তবে, প্রতিবার এ গাছের নিচে নতুন প্রেমিক-প্রেমিকারা এসে তাদের প্রেমের সাক্ষী রেখে যায় কৃষ্ণ ও রাধার কাছে। এবছর নিরবেই ফুটে গেলো লাল-হলুদ কৃষ্ণচূড়া ফুল। কিন্তু কেউ এলো না। কালবৈশাখী এসে ধুয়ে নিয়ে গেলো সব ফুলের বাহার, কিন্তু ভালোবাসার মানুষের চুলের খোঁপায় আর বাঁধা হলো না এ ফুল। করোনার প্রকোপে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো বন্ধ থাকায় ক্যাম্পাসের ফুলগুলোও ফুটে ঝরে পড়লো নীরবে।
রক্তিম কৃষ্ণচূড়া বেশি চোখে পড়লেও মূলত চার রঙের কৃষ্ণচূড়া বাংলাদেশে আছে। লাল, হলুদ, সাদা ও নীল। যদিও সাদা ও নীল সচরাচর দেখা যায় না। রঙের সাথে প্রেম ও কামের এই যে সমন্বয় তা আর কিছুতেই নেই। এমনকি কোনো এক উদ্যম শরীরের কিশোরী, বলা যাক সুনীল বাবুর বরুণার কথা, তাঁর ভরাট বুকের সুগন্ধি রুমালেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই সুগন্ধি গন্ধ কৃষ্ণচূড়ার দুয়ারে এসে ইন্দ্রীয় অতীত হয়ে যাবে নিমেষেই।
রূপ-রঙ ও গন্ধের যূথবদ্ধতায় লাল কৃষ্ণচূড়া চোখের সমীপে ফুটে থাকে, তখন অনবদ্য এই ফুলের মাধুর্য অবলোকন করে, আমরা প্রত্যেকেই আনমনে শিল্পী কিশোর কুমারের গান গেয়ে দেই- ‘এই সেই কৃষ্ণচূড়া, যার তলে দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ হাতে হাত, কথাই যেত হারিয়ে।’ হারিয়ে যেতে চাওয়া একটা অভিলাষ মাত্র। প্রতিটি মানুষ হারিয়ে যেতে চায়। হারিয়ে যাওয়ার অনেক মাধ্যম হতে পারে; কথা, ফুল, মায়া, বন্ধন, বিচ্ছেদ, যৌবন এবং মানুষ। হতাশায়ও মানুষ হারিয়ে যেতে পারে। তবে কৃষ্ণচূড়া ফুলের কাছে হতাশার যেন লেশমাত্র স্থান নেই, কেবলই প্রফুল্লতা।
কতজন যে মানুষে মানুষে হারিয়ে গিয়ে জমিয়ে গেছে জীবন। কতজন যে ফুলে ফুলে হারিয়ে গিয়ে ভরিয়ে গেছে পৃথিবী। কালের তাল পাতায় তার হিসাব রাখা হয়নি। রাখার প্রয়োজন পড়েনি। মানুষ হংসের মতো জলটুকু রেখে দুধটুকু খেয়ে নেয় সর্বদা। ফলে আমরা অনেকেই জানি না, রাধাচূড়া ও কৃষ্ণচূড়া ফুল কীভাবে আমাদের হলো। না জানার কারণ যৌক্তিক। কেননা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবদ্দশায় অনেক গাছের নামকরণ করে ছিলেন। সে সমস্ত ফুল কোনোটাই ভারতবর্ষের ছিলো না। তেমনি একটি ফুল আফ্রিকান টিউলিপ। রবীন্দ্রনাথ এই গাছের নাম দিয়েছিলেন অগ্নিশিখা।
কিন্তু কৃষ্ণচূড়া ফুলের নাম বরীন্দ্রনাথ বা সমসাময়িক কোনো কবি বা লেখক দেননি। এর আগমনও প্রাচীন। তাই উপমহাদেশে এ ফুলের ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায় না, ভারতবর্ষে কে এর নাম দিয়েছে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ও কনকচূড়া? কেবল এই ফুলের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। কৃষ্ণচূড়ার আদি নিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার, রাধাচূড়ার জন্ম ওয়েস্ট ইন্ডিজের অরণ্যালয়ে। বৃক্ষগুলো বাংলা মুলুকে আসে তিন থেকে চারশ বছর আগে। অনুমান করা হয়, পৌরাণিক দেবতা কৃষ্ণের মাথায় চুলের চূড়া বাঁধার ধরন থেকেই এই নাম হতে পারে।
নিসর্গ লেখক আমিরুল আলম খান তাঁর ‘পারুলের সন্ধানে’ বইটিতে একই কথা বলেছেন। বলেছেন- এক রাজকবি কৃষ্ণের মাথার চূড়ার বর্ণনা করতে গিয়ে রক্তবর্ণ এই ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেই থেকে কৃষ্ণচূড়া বলেই ডাকা হয়। অন্য দিকে কৃষ্ণের প্রেয়সী রাধাকে উপলক্ষ করে রাধাচূড়া নামকরণ করা হয়। সময়ের বিবর্তনে সেই কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়ার সৌন্দর্য ও সাদৃশ্য ভারতীয় উপমহাদেশে তরুণ তরুণীর কাছে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।
মানুষের অন্তর্নিহিত অভিব্যক্ত এই, মানুষ মাত্রই আত্মভোলা। এই আত্মভোলার জন্য মানুষ অনেক কিছু জানা ও বোঝা থেকে বঞ্চিত হয়। মানুষ আমৃত্যু আপনাকে ভালোবাসে। আপনাকে ঘিরে সে রচনা করে আপনার জগৎ। সে জগতে যা যা দরকার তাই গ্রহণ করে মানুষ। কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়াকে মানুষ যে ভালোবাসে তা কেবল আপনার আত্মতুষ্টির জন্য। যার কৃতিত্ব ফুলের। মানুষের নয়।
ফুল তাঁর সৌন্দর্য দিয়ে মানুষকে কাছে টানে। যেমন- কাছে টানে প্রেয়সীর গোপন অভিসার। রাধা কৃষ্ণকে কাছে টানে। প্রেয়সী রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়াকে। রাধাচূড়া ও কৃষ্ণচূড়া পাশাপাশি না থাকলে একটা অপূর্ণতা থেকে যায়। মনে হয় কিছু একটা নেই। টিপের অনুপস্থিতি রূপবতী নারীর হিন্দল ললাটের সকল গরিমা আড়াল করে ফুটে ওঠে ঠিক তেমন। তাই রাধাচূড়া ও কৃষ্ণচূড়া পাশাপাশি থাকাই শ্রেয়। যেখানে কৃষ্ণচূড়া লাগানো, সেখানে যেন রাধাচূড়াও লাগানো হয়।
এই যে কাছে টানার আকুল আবেদন, তার বাইরেও মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি আছে। মানুষ, কমবেশি সবাই চায়- এমন একটা জায়গায় সে হারিয়ে যেতে, যেখানে কেউ তাকে চিনে না, জানে না। মানুষের এই বাসনা আদিমকাল থেকে মনের এক কোণে সুপ্ত হয়ে পড়ে থাকে। কখনো কখনো তা তরঙ্গ তুলে জানান দেয়, সে হারিয়ে যেতে চায়। সেই যাই হোক, প্রিয়তম তরুণের মনের আঙ্গিনা রোমাঞ্চিত করে তোলে রাধাচূড়া, তা ধ্রুব সত্য।
রাধাচূড়া ও কৃষ্ণচূড়া এ সমাজের তরুণ তরুণীর অব্যক্ত কথাগুলোর সাক্ষী হয়ে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। সাক্ষী হয় গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের। রাধাচূড়ার আরও অনেক নাম আছে- রত্মগণ্ডি, সিদ্ধেশ ও ও গুলেটুর। অন্যদিকে কৃষ্ণচূড়া ফুলকে অনেকে গুলমোহর বলে জানে।
কৃষ্ণচূড়া শুধু বৃক্ষের শাখায় নয়, কৃষ্ণচূড়ার আগুনের রঙ শোভা পায় গাছের তলাও। বিস্তৃত জায়গা জুড়ে সে তার উদারতা ছড়িয়ে দেয়। সংকীর্ণতা নয়, উদারতাই তার ধর্ম। যা প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতিমা হয়ে জীবনের সঞ্চার ঘটায় প্রাণে প্রাণে। দীর্ঘ প্রসারিত ফুলের প্রাচুর্যে লাল হয়ে ওঠে প্রকৃতি। রাধাচূড়া যে ভালোবাসতে পারে না। সে ভালো প্রেমিক নয়। ঠিক তদ্রুপ, কৃষ্ণচূড়া যে ভালোবাসে না, সে ভালো প্রণয়নী নয়।
প্রণয় শব্দটির মত স্নিগ্ধ কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া। শাশ্বত প্রেমের অর্ঘ্য হয়ে থাকুক প্রতিটি ভালোবাসাবাসি মানুষের হদয়ে, বলুক ভালোবাসি, ভালোবাসি। কাজী নজরুল ইসলামের একটি গানের লাইন দিয়ে শেষ করব, ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে।’
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
জাবি/হাকিম মাহি
রাইজিংবিডি.কম