ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

গল্প-২

ইমু কি আজও তনুর অপেক্ষায় আছে?

সজীবুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ৪ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইমু কি আজও তনুর অপেক্ষায় আছে?

গৃহবন্দি অবস্থায় তনুর পরিবার জোরপূর্বক তনুর গর্ভপাত ঘটায় আর কয়েক মাস পরই তনুর জন্য অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে। গর্ভপাতের খবর জানতে পেরে ইমু তার বাসায় বসেই শুরু করে প্রচণ্ড তাণ্ডব। ঘরের সব কিছু ভাঙচুর শুরু করে ইমু। তার একটাই কথা ‘ওরা আমার সন্তানকে খুন করেছে, আমি ওদের ছাড়ব না’।

নিজের ঘরের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ইমু সারাদিন বলতো, ‘তনু তুমি চিন্তা করো না, আমি তোমাকে নিয়ে আবার পালাব।’ এদিকে তনুর বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে, বিয়ের ঠিক আগের দিন তনুর বাবা হঠাৎ করে ইমুর বাবাকে এসে বলল, ‘দেখুন আমার মেয়ের একটা ভবিষ্যৎ আছে। আমি ওর জন্য বিয়ে ঠিক করেছি। আপনার ছেলের জন্য যদি এই বিয়ে ভেঙে যায়, তাহলে কিন্তু সেটা ভালো হবে না। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি, যেন আপনার ছেলে আমার মেয়ের বিয়েতে কোনো প্রকার বাঁধার সৃষ্টি না করে। আর যদি করে, তাহলে কিন্তু আমি ওকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।’

ইমুর বাবা তেমন কোনো উত্তর দেয়নি, সেদিন চুপচাপই ছিলেন, হয়েতো ভাবছেন কী করবেন? অতঃপর তনুর বিয়ের আগের দিন রাতে নিজের ছেলের কথা ভেবেই হোক আর তনুর বাবার কথা, ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ইমুকে অচেতন করে রাখা হয়েছিল প্রায় দেড় দিন। ঐ দিন সন্ধ্যায় বিয়ের সব কাজ শেষ করে তনুকে বিদায় দেওয়া হয়। ইমুর চেতনা আসে পরের দিন ভোর রাতে। উঠে শুধু একটা নাম তনু, কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারে তনুর বিয়ে হয়ে গেছে। শুরু হয় ইমুর বুকফাটা কান্না, কেন আমার সাথে তোমরা এমনটা করলা, এর থেকে ভালো ছিল তোমরা আমাকে খুন করতে। আমরা একে-অন্যকে ভালোবাসে বিয়ে করেছি, কী দোষ করেছি আমরা, তনুকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলে?

শুরু হয় অপেক্ষার পালা এই বুঝি তনু স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে এলো। অপেক্ষায় ঘরের সামনের বেরকুনিতে বসেই কেটে যায় ইমুর প্রায় ২টা বছর। আজ বুঝি তনু আসবে, আজ বুঝি তনু আসবে। হঠাৎ করে প্রায় ২ বছর পরে এক বিকেলে ইমু দেখল তনুকে। ওর বাড়ির সামনে একটি মাইক্রো থেকে নামল, কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। ইমু কয়েকবার তনুকে ডেকেছিল, কিন্তু তনু একবারের জন্যও ফিরে তাকাল না, সোজা ঘরে চলে যায়। ইমু ভেবেছিল স্বামী আছে ওর সঙ্গে, তাই মনে হয় তাকাল না। কিন্তু তনু ওর বাচ্চারসহ একাই এসেছিল।

তনুর সঙ্গে ইমুর যে করেই হোক কথা বলতে হবে, কিন্তু তনু কেন জানি ইমুকে এরিয়ে চলছে। কয়েকবার তনুকে বেলকনিতে দেখে ইমু ডাক দেয়, কিন্তু তনু কোনো উত্তরই দিচ্ছিল না। কোনোভাবেই ইমু যখন তনুর সঙ্গে কথা বলতে পারল না, তখন হঠাৎ করেই ইমু ওর বাবার কাছে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে আর বলতে থাকে, তোমরা আমাকে একবার তনুর সঙ্গে সামনা-সামনি কথা বলতে দাও। আমি তোমাদের সব কথা মেনে নেব, আমি একটি বারের জন্য তনুর সঙ্গে কথা বলতে চাই’।

দুইদিন ধরে কান্নাকাটির পর ইমুর বাবা তনুর বাবার সঙ্গে কথা বলে। ইমুর বাবা তনুর বাবাকে গিয়ে বলেন, দেখুন আপনার মেয়ের বিয়ের সময় আমি আপনার মেয়ের কথা ভেবেই ইমুকে ওইদিন ঘুমের ঔষুধ দিয়ে অচেতন করে রেখেছিলাম। আপনার মেয়ের তো একটা ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু আমার ছেলেটা এখন সেই আপনার মেয়ের অপেক্ষায় বসে আছে। ও তনুর সঙ্গে একবার কথা বলতে চায়, এরপর ও আর কোনোদিন ঝামেলা করবে না। আপনি শুধু একবার তনুর সঙ্গে ইমুকে কথা বলতে দিন।

তনুর বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তারপর ইমুর বাবা বলেন, দেখুন আমি কিন্তু তখন আপনার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই নিজের ছেলের সঙ্গে এমন কাজ করেছিলাম, আপনি একটু আমার ছেলের কথা ভাবুন। ওর এখন সারাটা জীবন পড়ে আছে। ও আপনার মেয়ের কোনো ক্ষতি করবে না, এর নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি। অতপর তনুর বাবা রাজি হয়।

ইমু বাবা-মাসহ পরের দিন বিকেলে তনুর বাসায় যায়। ইমুর গায়ে ছিল তনুর পছন্দ করে কিনে দেওয়া নীল রঙের পাঞ্জাবি, ওরা বিয়ে করার দিন তনু পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল। তনুর বাবা-মার উপস্থিতিতে ওর ভাই তনুকে ডেকে আনে। তনুকে দেখে ইমুর মনে হয় যেন কয়েক যুগ পরে ওদের দেখা। তনুর বাবা বলে কী বলবে বল? ইমু বলল তনু আপনাদের সামনে কথা বলবে না, আমি একা কথা বলতে চাই। তনুর বাবা মোটেও রাজি না, ইমু বলল আমি কথা দিচ্ছি, আমি এমন কিছু করব না যাতে তনুর কোনো ক্ষতি হয়। তাতেও রাজি না তনুর বাবা, অবশেষে তনু ওর বাবাকে বলল আমি ইমুর সঙ্গে একা কথা বলব।

ইমু আর তনু পাশের রুমে যায় কথা বলতে, ইমু বলে কেমন আছো? তনুর মুখে কোনো কথা নেই। ইমু বলে এতদিন পরে কথা বলছি তাও চুপ করে আছো? তনু বলল, যা বলার দ্রুত বলো। তুমি কী মনে কর? তুমি বিয়ে করেছ বলে আমি তোমাকে ঘৃণা করি, মোটেও না। আমি জানি তুমি বিয়েতে রাজি ছিলে না। এখনও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি। তোমার কি ধারণা, তোমার এই সংসার আমাদের মধ্যে বাঁধা সৃষ্টি করছে, মোটেও না। তুমি যেই মুহূর্তে এই সংসারের বাঁধন ছেড়ে আসতে পারবা, আমি তখনই তোমাকে বিয়ে করতে রাজি আছি, সেটা হোক আজ, কাল অথবা বৃদ্ধ বয়সে। আমি সারা জীবন তোমার অপেক্ষায় থাকব। এই সমাজ যদি মৃত্যুর আগে আমাদের এক হতে না দেয়, তাহলে মৃত্যুর পরে ওই দুনিয়াতে হলেও এক হব, সে সময় আমাদের মধ্যে ধর্মের কোনো বাঁধা থাকবে না।

তনু অনেক কষ্ট করে চোখের পানি ধরে রেখেছিল হঠাৎ করেই বলে, কথা বলা শেষ? তাহলে চলে যাও। ইমু খুব ভালো করেই জানে এর মানে কী, তনু ওর সামনে কাঁদতে চায় না, তাই বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে আসতেই দেখল তনুর মায়ের কোলে তনুর ফুটফুটে সন্তানটি। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল নাম কী ওর?  তনুর মা বলল সৃষ্টি। ইমু মুচকি হেসে চলে আসল। ইমুর হাসার রহস্য কেউ বুঝল না। এর কয়েক দিন পরই তনু শশুর বাড়ি চলে যায়।

এই পর্যন্ত ইমু আর তনুর ভালোবাসার পুরো কাহিনিটা তারা দুইজন ছাড়া কেউই জানত না। তনুর সঙ্গে শেষ কথা বলার কয়েক দিন পর ইমুর ছোট চাচার বিয়ে হয়। এই সময় ইমুর অন্য ভাইবোনেরা অনেক চাপ দিয়েই পুরো ঘটনাটি শোনে ইমুর কাছ থেকে। ইমুর এক ভাই আমার কলেজের বন্ধু ছিল নাম মোস্তাফিজ। আমি ওর মুখ থেকে শুনেছিলাম। ইমুকে মোস্তাফিজ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ভাইয়া তুমি তো অনেক বুদ্ধিমান, তখন সব কিছুই বুঝতে যে তোমাদের কেউ মেনে নিবে না, তাহলে তনু আপুকে ভালোবেসে ছিলে কেন?

ইমু একটা হাসি দিয়ে বলল, আরে ভালোবাসার উপর কারও হস্তক্ষেপ নেই, ভালোবাসা ঐশ্বরিক। সবার মুখে আমি এ কথায় শুনেছি যে, ভালোবাসা নাকি সৃষ্টিকর্তার দান। তবে, ভালোবেসে কাউকে বিয়ে করতে গেলে জাত, ধর্ম, বর্ণ আসে কেন আমি তা বুঝি না! দেখ আমাদের সাথে তনুর পরিবারের ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি তনু একসঙ্গে খেলতাম, ঘুরতাম তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। ধর্মীয় থেকে শুরু করে পারিবারিক সব অনুষ্ঠানে দুইটা পরিবারই একে অন্যেরটায় যেতাম তাতেও অসুবিধা ছিল না, কেউ একবারও নিষেধ করেনি।

শুধু অসুবিধা একটাই ভালোবাসলে, বিয়ে করতে চাইলে। তখন সমাজের লোকজন দূরে থাক পরিবারের লোকই তা মেনে নিতে চায় না। অথচ আমরা নাকি অসাম্প্রদায়িক, পহেলা বৈশাখের সময় আমরা সবাই বাঙালি বলে পরিচয় দিয়ে বলি আমরা বাঙালি এটাই আমাদের বড় পরিচয়। অথচ ভিন্ন ধর্মের কাউকে ভালোবাসলে আমরাই ছি ছি করি, এই হচ্ছে আমাদের অসাম্প্রদায়িকতা।

ওই সময় আমরা ভাই-বোনেরা একদম চুপ ছিলাম, বলার মতো কিছু ছিল না। এরপর ইমু নিজে থেকেই বলল, ওই দিন তনুর বাচ্চার নাম শুনে কেন হাসছিলাম জানিস, আমি আর তনু মিলে ঠিক করেছিলাম আমাদের সন্তানের নাম রাখব সৃষ্টি, কারণ ও আমাদের ভালোবাসায়র প্রতীক হবে।’

আমি আমার বন্ধুকে সাথে সাথেই জিজ্ঞেসা করেছিলাম, ইমু ভাইয়া এখন কোথায়, কী করে? এখনও কি তনুর অপেক্ষায় আছে? আমার বন্ধু একটু মলিন মুখেই বলল তা সঠিক জানি না। আমি বললাম, কেন তোর ভাইয়ের সাথে আর কথা হয় না। মোস্তাফিজ বলল, তনু আপু চলে যাওয়ার কয়েকমাস পরই ইমু ভাইয়া মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে ভাইয়া সারাক্ষণ নিজের সাথে একা একা বিরবির করে কথা বলে। কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা করানো হয়েছে, লাভ হয়নি।

ডাক্তার বলেছে, চিকিৎসা চালিয়ে যেতে, হয়তো একদিন ঠিক হয়ে যাবে। এই কথা শোনার পর আমি পুরো নির্বাক হয়ে গেলাম, আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ইস! যদি ডাক্তার এই ঘটনাটি জানতো, তাহলে হয়তো বা এই কথা বলতো না।

** ইমু-তনুর কি মিলন হয়েছিল?

লেখক: শিক্ষার্থী, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


যবিপ্রবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়