ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

স্যার আপনাকে বলছি 

শাহাব উদ্দীন ওয়াসিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ২৫ মে ২০২১  
স্যার আপনাকে বলছি 

কখনো একটি ডিম বিক্রি করে, কখনো বাড়ির আঙিনায় মায়ের পরম যত্নে বেড়ে ওঠা গাছের লাউগুলো বিক্রি করে ছেলের টিউশনের টাকা দিয়েছি। কখনো এক বেলা কম খেয়ে নিজের স্বাদ-আহ্লাদকে বলি দিয়ে খোকাকে একটা নতুন জামা কিনে দিয়েছি। ভালো জুতা হয়তো কিনে দিতে পারিনি, তবে হ্যাঁ আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করেছি, বোধহয় স্বার্থক হতে চলেছে। 

আমার খোকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। আমার জন্য যখন একটা শাড়ি কিনে আর ওর বাবার জন্য একটা লুঙ্গি এনে বলবে এগুলো তোমাদের জন্য উপহার, তখন মাথায় হাত দিয়ে বলবো, বড় হ খোকা। আর কিছু চাওয়ার নেই। হঠাৎ কি যে হল! খোকা আমার কয়দিন মানুষের দোকানে থাকলো। তার কয়দিন পরে পাইপ লাইনে, আর কয়দিন বিদ্যুতের লাইনের কাজ করলো। কি জানি করোনা আসছে দেশে, তাই ভার্সিটি বন্ধ। টিউশনটাও নেই! আমাদের সময়তো স্কুল এত বন্ধ হতো না! পাশের বাড়ির লোকজন টিককারি করে, জীবনটা মাটি করলি ছেলেডার পেছনে। আগেই কইছিলাম আমার ছেলের মতো কাজে লাগাইয়া দে। আমার ছেলে কিন্তু হেড মিস্ত্রি আর তোরডা আমার ছেলের হেল্পার। এত পড়লেখা করে হেল্পার! মা আমার শুধু মুখ লুকিয়ে কাঁদে আর কয়, দরকার নাই তোর বাড়িতে থাকার। তোদের স্যারদের বল ভার্সিটি খুলে দিতে। তোর এমন টাকা কি আমি চাইছি?

স্যার আপনাকে বলছি। মূল বিষয়টা হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের এত সংগঠন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এত সংগঠন, তারা কেন শিক্ষার্থীর চাওয়ার দিকে নজর দিচ্ছেন না? কোনো বিবৃতি আজ পর্যন্ত পেলাম না বা উদ্বেগও প্রকাশ করতে দেখলাম না। হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষক তাদের নিজস্ব টাইমলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়ে বা শিক্ষার্থীদের দুর্দশা নিয়ে লিখছেন। যারা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সঠিক বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরেছেন, তাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই। 

আমি জানতে চাই, বাংলাদেশের মতো আর কোন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৪ মাস বন্ধ আছে? এখনো কি কোনো স্যারের বা কর্মকর্তাদের বেতন বন্ধ করা বা কমানো হয়েছে? তাহলে শিক্ষা না দিয়ে এই টাকাগুলো আসলে কি বৈধ হচ্ছে? শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে ধ্বংসের পথে, সেখানে শিক্ষাগুরুদের উদ্বেগ কতটুকু? আপনারা করোনার প্রথম ঢেউ, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা বলে শিক্ষার্থীদের স্বান্তনা দিচ্ছেন। অন্যদিকে করোনাকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোক সমবেত হয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছেন। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সাথে বা একসাথে কয়েকশো লোক মাস্ক খুলে একটি ফুলের ডালি ধরে ফটোসেশনের চেষ্টাও তো কম হলো দেখলাম না। ফুল দেওয়া নিয়ে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি করলেন শহীদ বেদিতে। তবুও মানলাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা প্রয়োজন। তবে আমার বাবা, ভাই, বোন ও পরিবারেরর অন্যান্য লোকজন যে প্রতিনিয়ত গণপরিবহনে যাত্রা করছেন, শপিং মলে যাচ্ছেন, গার্মেন্টেসে যাচ্ছেন তাদের থেকে কি করোনার ভয় হচ্ছে না। এই বড় একটা সময়ের ব্যবধানে আজও করোনার টিকা দেওয়া তো দূরের কথা, তথ্য সংগ্রহ করাই শেষ হচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের। আর করোনার টিকা নেওয়ার পরও তো আক্রান্ত হচ্ছে না, এমনতো নয়। 

আমি চাই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই আগের মতো ক্লাসে ফিরে আসুক। আপনাদের ক্লাসের সেই মহামূল্যবান লেকচারগুলো মিস করি। মিস করি বন্ধুদের, মিস করি আড্ডা। আর হ্যাঁ আমিসহ আমার বন্ধুদের বয়সতো বসে নেই। আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া এই দেড় বছরকে ফিরিয়ে দেবে? অনেকের পরিবার তাদের দিকে চেয়ে আছেন কবে খোকা ইনকাম কবে মা-বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ করবে? মা-বাবাকে অবাক করে দিয়ে কবে বলবে, মা এই শাড়িটা তোমার জন্য? বাবা এই লুঙ্গিটা, গেঞ্জিটা তোমার জন্য? 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীর আয়ের পথ টিউশন বন্ধ। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর সবাই এখন ফ্রি ফায়ার, পাবজিসহ অন্যান্য গেম খেলতে ব্যস্ত। আর ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভের শিক্ষার্থীরা ওই গেমের দর্শক। হয়তো বাবা-মা ফোন কিনে দিলে ওরাও খেলতে শুরু করবে। ওসব পড়াশোনার ধার তারা এখন ধারে না। আমার জানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গরীব শিক্ষার্থী আজ মাঠের কাজ, দোকানে থাকা, গার্মেন্টেসে কাজ শুরু করেছেন। আমি কোনো কাজকে ছোট করে দেখি না। তবে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে এমন কাজ আমরা করতে চাই না। আমাদের নিচের ব্যাচগুলোর অনেক শিক্ষার্থী আজ কাজে যায় কী জন্য জানেন? ফ্রি ফায়ারের ডাইমন্ড কেনার জন্য যে টাকা লাগবে, সেটা জোগাড় করার জন্য। 

বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ ফ্রি ফায়ারের একটিভ আইডি আছে। কয়েক লাখ আইডি আছে, যার পেছনে খরচ হয়েছে ২০ হাজারের অধিক টাকা। এগুলো কারা খেলে? আপনার মতো শিক্ষক বা আমার বাবা-চাচার মতো বয়সের লোকেরা খেলে না। এরা সবাই শিক্ষার্থী। এরা সবাই নাকি জাতির ভবিষ্যত! এইতো সেদিন ফ্রি ফায়ার গেমের জন্য পঞ্চাশ টাকা না পেয়ে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলো। আর এখনতো শিক্ষার্থীদের কমন ডায়ালগ, তাদের মা-বাবার কাছে, স্মার্টফোন কিনে দাও, না হলে খাওয়া-দাওয়া করবো না, আত্মহত্যা করবো বা বাড়িতে থাকবো না ইত্যাদি। 

শিক্ষাব্যবস্থার এই ধ্বংসের দায় কি আপনাদের উপর একটুও যায় না? প্রশ্ন করুন নিজের কাছে। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি দেব।’ আজ আমি বলছি, ‘আমাকে নন্দলালের মতো কিছু শিক্ষক দিন, পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেবো।’ জানি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতেগোনা কিছু ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, তেলবাজ বা পেটনীতি নিয়ে ব্যস্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী ছাড়া সবাই শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবেন। যদিও ওই তেল বাজরাই আজ আপনাদের নেতা বা কলকাঠি নাড়া যায় এমন আসনে বসে আছেন। তবে আপনারা এগিয়ে আসলে আশা করি তাদের তেল শুকিয়ে যাবে। 

একসঙ্গে সবাই বলবো, আপনারা দুর্জন। দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। আর যদি আপনারাও এভাবে নন্দলালের মতো শুধু বসেই থাকেন, তবে আমার জিজ্ঞাসা ভাব সম্প্রসারণের সেই ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য’ আসলে কারা?

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

ইবি/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়