ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের রোমাঞ্চকর অধ্যায় গণরুম

ইমন ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪২, ১৮ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১২:৪৪, ১৮ জুলাই ২০২১
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের রোমাঞ্চকর অধ্যায় গণরুম

গণরুম হলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শ্রেষ্ঠ একটি অধ্যায়। যে অধ্যায়ের সূচনাটা প্রাণবন্ত ও হাস্যজ্জল হলেও শেষটা বেশ বেদনাদায়ক। চার দেয়ালের বলিষ্ঠ গহীনে চাঁপাকান্না আর খুনসুটির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে গণরুমের জীবন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবথেকে আনন্দঘন ও সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর একমাত্র স্থল ভালোবাসার গণরুম। নামটি মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুষ্টুমি ভরা সেই সোনালী সময়।  যেন এটি ভালোবাসার এক উদ্যানের নাম। যে উদ্যানে সহস্র ক্যাম্পাসপ্রেমীদের বিচরণ। প্রতিটি প্রান্তে লুকিয়ে রয়েছে হাজারো চরিত্রের হাজারো গল্পের রোমন্থন। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুবর্ণা আক্তার। তিনি গণরুম স্মৃতি নিয়ে বলেন, স্কুল, কলেজ জীবন শেষ করে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম, তখন ঠাঁই হলো ১০০ জনের সম্মিলিত গণরুমে। যেখানে থাকার জায়গা ছাড়া আমাদের জিনিসপত্র রাখার জন্য আলাদা কোনো জায়গা ছিল না। খুব গাদাগাদি করে থাকতে হতো। তাই প্রথম দিকে সকালে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বের হলে আর গণরুমে ফিরতে ইচ্ছে হতো না। বার বার মনে হতো কখন সিনিয়র আপুদের মতো আমিও একটা রুম পাবো। কিন্তু অল্প সময়েই গণরুমের চরিত্রগুলোর সাথে বন্ডিংটা গণরুমের সব কষ্টকে ছাড়িয়ে যায়।  আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো সব থেকে মজার সময় আর সুন্দর গল্পগুলো এখানেই তৈরি হয়। সব ধরনের বন্ধুই পাওয়া যায় এখানে। যারা রাত ৩টা বাজেও বন্ধুর অসুখে অস্থির হয় আর হাসপাতালে ছুটে চলে। এখন বাসায় থেকে গণরুমে বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে রান্না করে খাওয়া, পরীক্ষার আগে সবাই একসাথে পড়তে বসা, সবাই দলবেধে ডিপার্টমেন্টে যাওয়া খুব মিস করি। ক্যাম্পাস খুললে গণরুম ছেড়ে রুমে উঠবো মনে হলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় আর মনের অজান্তেই বলে উঠি ‌‘গণরুম একটা ভালোবাসা’।

গণরুমের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মোমেনা আক্তার বলেন, দিনগুলো স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকুক। ক্যাম্পাস লাইফের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আবাসিক অবস্থান। ২০১৭ সালে 'এ-১০৫' নম্বর গণরুম দিয়েই আমার আবাসিক যাত্রা শুরু হয়।  ওই রুমে ১ বছর ছিলাম আমরা। গণরুম এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করে, যেখানে মানুষকে মানুষের নানা দিক শেখায়। হাসি-কান্নার রূপ কেমন হয়, তা আমরা গণরুমের প্রত্যেকটা সদস্য থেকে বুঝতে শিখি। আমাদের গণরুমে আমরা সবাই একই ব্যাচের হওয়ায় দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এ যেন এক সংসার, যেখানে একজনের হাসি সবারই হাসি, একজন রান্না করলে সবাই খেতাম। কোনো এক উৎসব হলে একসাথে উপভোগ করতাম। সারাদিন ক্লাস-টিউশনের নানা ব্যস্ততার মধ্যেও কারও মধ্যে কোনো বিরক্তের ছাপ পড়ত না। যদিও কোনো কারণে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতো, পরক্ষণে তা মানিয়ে নিত। এখানকার ভালো লাগা আর খারাপ লাগার অনুভূতিগুলো যেন একইরকম হয়ে আছে সেই শুরু থেকে। অনেক বেশি মনে পড়ে সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা। কেবল স্মৃতি হয়েই বেঁচে থাকুক সেই  দিনগুলো।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর, আবেগের এবং স্মৃতিবিজড়িত জায়গার নাম হলো গণরুম। প্রথমে এত অপরিচিত মানুষের সাথে একসাথে থাকাটা একটু কষ্ট হলেও কয়েকদিন পর এদের মাঝেই আত্মার বন্ধন তৈরি হয়। সমবয়সী হিসেবে সবাই দলবেধে ঘোরাঘুরি, খেতে যাওয়া, ক্লাসে যাওয়া, পড়াশোনা করা অন্য এক অনুভূতি। গণরুমের মাধ্যমেই বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনযাপন ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়। পরিবার থেকে দূরে গিয়ে গণরুমে ওঠার পর পরিবারের শূন্য গণরুমের বন্ধুরা অনুভব করতে দেয় না। গণরুমের সবাই মিলেই যেন একটা পরিবার। কেউ অসুস্থ হলে, কেউ কোনো বিপদে পড়লে, কারো কোনো সাহায্য লাগলে প্রথম বর্ষে গণরুমের শিক্ষার্থীরাই সবার আগে এসে পাশে দাঁড়ায়। গণরুমের মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলকে ছাত্ররা তাদের সেকেন্ড হোম হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করে।

এছাড়াও গণরুমের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী সানজিদা ইসলাম তন্বী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাস শুরু হওয়ার একদিন আগেই ব্যাগ, সুটকেস নিয়ে গ্রাম থেকে পৌঁছে গেলাম রাজধানীতে। পূর্ব পরিকল্পনা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ওঠার পরিকল্পনামাফিক উঠে গেলাম বেগম রোকেয়া হলের গণরুমগুলোর একটিতে, রুম নম্বর ৫৮। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসন সমস্যার কথা কারোরই অজানা নয়। এই আবাসিক হলগুলোতে থাকে গণরুম নামের আলাদা কিছু কক্ষ যেগুলোকে বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন আসা শিক্ষার্থীদের আতুরঘর। এখানে একটা ঘরে গাদাগাদি করে থাকে ২০/২৫/৩০ বা তারও অধিক শিক্ষার্থী। 

একটি কক্ষেই সৃষ্টি হয় একাধিক গল্প। যার কোনোটা সুখময় আবার কোনোটা হৃদয়বিদারক। এবার আসা যাক আমার গল্পে। প্রথমদিন গণরুমে কতগুলো অচেনামুখের ভিড়ে ভরসাযোগ্য কোনো মুখের সন্ধানে চোখ দু’টি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এরপর নকশী, ফাহমি, মনুফা, পূর্ণিমা, ঐশ্বী, শাহানা আরও কত রুমমেট পেলাম, যাদের সাথে খুনসুটি আর গল্প আড্ডায় মেতে উঠতাম সবসময়। গণরুমের আড্ডা যেন আমার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করে। আমার কাছে গণরুম মানে পারস্পরিক ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং একতাবদ্ধের এক মেলবন্ধন। তেতুল পাতায় নয়জন কথাটি যেন গণরুমকেই উৎসর্গ করে বলা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ সাকিব বলেন, আমাদের দেশে হলের নাম শুনতেই যে শব্দটি মাথায় আসে সেটি ‘গণরুম’। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাত্র অথচ গণরুমে থাকেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমিও গণরুমে কাটিয়ে আসা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের একজন। ঘুমের অসুবিধা ও নানা বিরক্তি দিয়ে শুরু এই গণরুম যে একসময় ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়, তা মানতেই হয়। 

আমার গণরুমের শুরু হয় কিছু সৌহার্দপূর্ণ বন্ধুবান্ধবের সাথে, যাদের সাথে থাকলে পৃথিবীর বাকি সমস্যা ভুলে থাকা যেতো, সারাক্ষণ বিনোদন দাতা বন্ধুবান্ধব ও যেমন ছিল, তেমনি পড়াশোনায় ডুবে থাকা বন্ধু ও ছিল। এখানে ‘আমার’ বলতে কোনো শব্দ ছিল না, সবই আমাদের। বিভিন্ন মানসিকতার শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনা একসূত্রে গাথার পেছনের কারিগর এই গণরুম। এক হয়ে থাকার যে শিক্ষা, গণরুমে না থাকলে সেটা কখনো অর্জন করতে পারতাম বলে মনে হয় না। গণরুম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে মনে করি, যার স্মৃতি চিরঅম্লান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী সংগীতা কর্মকার তিথি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকা ছাড়া পরিপূর্ণ হয় না। জীবনের অন্যরকম এক অনুভূতি এই হলে থাকা। আমি জাহাঙ্গীরনগরে পড়ার সুবাদে ফজিলাতুন্নেছা হলে থাকার অনুমোদন পাই। সিংগেল সিট না থাকায় আমাদের প্রথম বর্ষের সবাইকে উঠতে হয় গণরুমে, স্টুডেন্ট সংখ্যা বেশি থাকায় দুইটি গণরুমে আমাদেরকে ভাগ করে দেওয়া হয়, সেখানে আমরা যার যার মতো মেঝেতে বিছানা করে নিয়ে নিজেদের জিনিসপত্র রেখে শুরু করে দেই আমাদের হল জীবন। সেখানে নানা শহর, গ্রাম বা মফস্বল থেকে আসা নানারকম ব্যবহার, মেন্টালিটি এর মানুষ। 

প্রথম দিকে হয়তো একটু অসুবিধা হতো, তারপর তাদের এতটাই আপন করে নিয়েছিলাম, যে করোনার এই দীর্ঘ ছুটিতে তাদেরই অনেক বেশি মিস করেছি। গণরুমে অনেক অনেক স্মৃতি জমা হয়ে গিয়েছে আমার, মাত্র দেড় বছরেই। এই দেখা গেলো কোন বান্ধবী রান্না করছে তার কাছে গিয়ে বলেছি আজ কিন্তু তোর কাছে খাবো, সেও আমার কথাকে সিরিয়াসলি নিয়ে আমাকে খাইয়েছে, আবার পাশের বেডের তমা আর উস্মিতার সাথে ক্যাম্পাসের মন্দিরে যাওয়া, গণরুমে চাদা তুলে প্রতি ফ্রেন্ডের জন্মদিন পালন করা, বান্ধবীদের সাথে তাদের কাজে হেল্প করা, একসাথে কয়েকজন বান্ধবী ঘুরতে বের হতাম ছুটির দিনগুলোতে, এমনি অনেক অনেক স্মৃতি দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেছে আমার গণরুমের জীবন। পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠুক, আবারও স্মৃতির পাতায় জমাতে হবে অনেক কিছু।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

জাবি/মাহি 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়