৫ মাসের সেশনজটে কুবি শিক্ষার্থীরা
এমদাদুল হক, কুবি || রাইজিংবিডি.কম
শিক্ষক-উপাচার্য দ্বন্দ্ব, দুই ঈদের ছুটি, কোটা বাতিলের আন্দোলন ও বন্যা পরিস্থিতি মিলিয়ে অন্তত ১৫৬ দিন বন্ধ ছিল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চেপেছে দীর্ঘ সেশনজট। এতে করে তারা চাকরিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে রিকোভারী প্লান তৈরি করে সেশনজট নিরসনের দাবিও জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছ, চলতি বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ শিক্ষকরা উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে উপাচার্য কার্যালয়ে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। এর জেরে উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এরপর ১২ মার্চ শিক্ষক সমিতি সাত দফা দাবি ঘোষণা করে তা বাস্তবায়নের জন্য ১৩ ও ১৪ মার্চ প্রথমবারের মত দুই দিনের কর্মবিরতি পালন করে। এরপর ১৯ থেকে ২৭ মার্চ আবারো সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মবিরতিতে যায় শিক্ষক সমিতি।
পরবর্তীতে ২৯ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ দিনের জন্য বন্ধ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ঈদ উপলক্ষে ঘোষিত বন্ধ শেষ হওয়ার আগেই ১৭ এপ্রিল শিক্ষক সমিতি ২১ এপ্রিল থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত তিনদিনের শ্রেণি কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেয়। এরপর সাত দফা দাবি আদায়ে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় তারা। তারপরও দাবি আদায় না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে দপ্তরগুলোতে তালা লাগিয়ে দেয়।
২৮ এপ্রিল উপাচার্য দাপ্তরিক কাজে দপ্তরে প্রবেশ করতে চাইলে শিক্ষকদের সঙ্গে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক-বর্তমান নেতাকর্মীদের ধাক্কাধাক্কি ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ২৯ এপ্রিল উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের শ্রেণি ও প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ চূড়ান্ত পরীক্ষাও বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষক সমিতি। পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে ৩০ এপ্রিল এক জরুরি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়। ৫ জুন ৯৫তম জরুরি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঈদুল আযহার ছুটির পর ২৩ জুন থেকে ফের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে ১৬ দিন।
এরপর পেনশন স্কিম প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নির্দেশনা মোতাবেক সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ২৫ জুন থেকে ২৭ জুন অর্ধদিবস কর্ম বিরতি পালন করে কুবি শিক্ষক সমিতি। দাবি আদায় না হওয়ায় ৩০ জুন পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করে। পরবর্তীতে ১ জুলাই থেকে কুবি শিক্ষক সমিতির সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও ৪ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মোট ৪২ দিন বন্ধ থাকে।
এদিকে সিন্ডিকেটে গত ১২ জুলাই থেকে অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সেটি বর্জন করেন শিক্ষার্থীরা এবং ১৮ আগস্টের মধ্যে স্বশরীরে শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর আল্টিমেটাম দেন। সে অনুযায়ী ১৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও দেশের ফেনী-কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার ফলে আবারও প্রায় এক সপ্তাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকে। সবশেষে গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হয় ক্লাস পরীক্ষা। তবে এর মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর, বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষসহ প্রশাসনিক পদসমূহ শূন্য থাকায় স্থবিরতা কাটছে না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ সেশনের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিমা সুলতানা রাতুয়া বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গত পাঁচ মাসে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে গেছে। যদিও সব সমস্যার এখন সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে এটা একটা অপূরনীয় ক্ষতি। কেননা করোনা মহামারির জন্য আমাদের পড়াশোনার যে ব্যাঘাত ঘটেছিল, সেটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ মাসের মতো বন্ধ ছিল। এতে করে আমাদের চলতি সেমিস্টারের পড়াশোনা একেবারে থেমে যায়। অনেক শিক্ষার্থী এই গত পাঁচ মাসে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। আমাদের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা এবং কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি থেকেও আমরা অনেকটাই দূরে সরে যাই। এখন সেশনজটের থেকে পরিত্রাণ পাওয়া আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একই ব্যাচের আইন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী রাফসান বলেন, এ বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার কারণে ক্লাস-পরীক্ষা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। ফলে আমরা শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। আমরা সেশনজটে আটকে আছি। তাই আমরা সবাই চাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। যাতে আমরা পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ পাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী গোলাম দস্তগীর বলেন, এ বছরের শুরু থেকেই নানা সমস্যার কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ ছিল, ক্লাস হয়নি। ফলে ৫-৬ মাসের একটা সেশনজটের মধ্যে আমরা রয়েছি। এ সেশনজট নিরসনে প্রসাশনের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ সেশনের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নূর আখের মাওলা বলেন, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন সময়। আর এখানেই টানা পাঁচ থেকে ছয় মাস নানা আন্দোলনের জন্য নষ্ট হয়েছে। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় যারা টিউশনি করে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যেতো, তারা এ কয়েকটি মাস খুব কষ্টে কাটিয়েছে। অনেকে তো শেষ সম্বল টিউশনিও হারিয়েছে। অর্ধবর্ষ পিছিয়ে থাকায় সরকারি চাকরির বয়সে একটা বড় প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার যে স্বাভবিক ধারা ছিল, তা ব্যহত হয়ে পড়েছে।
শিক্ষার্থীদের সেশনজট নিরসনে প্রশাসন আসলে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে উপাচার্যের পরিবর্তে কুবিতে দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মো. জাকির ছায়াদউল্লাহ খান বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়া পরপরই বিভাগীয় প্রধান এবং ডিনদের সঙ্গে একটি মিটিং করেছি। মিটিংয়ে সব বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে প্রায় ছয় মাসের যে সেশনজট তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে। এখন পর্যন্ত মোটামুটি সব বিভাগই তাদের পরিকল্পনা দিয়েছে। আমরা আগামী এক বছরের মধ্যে তিনটি সেমিস্টার শেষ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। শিক্ষকরাও সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন। আশা করি, শিক্ষার্থীদের যে প্রায় ছয় মাসের সেশনজট রয়েছে, তা পূরণ করা সম্ভব হবে।
/মেহেদী/