মা যেন গহিন আঁধারে চাঁদের আলো
জেসমিন জুঁই || রাইজিংবিডি.কম
লিখতে বসেছি মাকে নিয়ে গল্প। আমার মায়ের পছন্দের অভিনেত্রী হলেন ববিতা। তিনি মনে মনে চাইতেন, তার যেন ববিতার মতো দেখতে একটি মেয়ে হয়। কী আশ্চর্য, এই কথা মা এতটা বছর আমার কাছ থেকে গোপন রেখেছেন। মা একদিন ববিতার ছবি দেখে বলছিলেন, “আমার ইচ্ছে ছিল, আমার মেয়ে যেন দেখতে ববিতার মতো হয়। আমার সে ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তুমি দেখতে ববিতার মতো।”
আমি হাসি চেপে বলি, আমি কীভাবে? মা বলেন, “কেন? আমার চোখে তুমি ববিতা। তোমার ঠোঁট, নাক, চোখ সবকিছুতেই ববিতাকে দেখি।” তারপর থেকে আমি নিজেকে মায়ের চোখে অভিনেত্রী ববিতা সদৃশ ভাবি, আর মনে মনে হাসি।
মায়ের স্মৃতি মানে হাজারো কথার ফুলঝুরি, মায়ের প্রতিটি আত্মত্যাগ যেন নকশি কাঁথার মাঠের এক-একটি সুঁই-সুতোর ফোঁড়। মায়ের হাসি যেন আকাশের চাদরে অগণন নক্ষত্রের জলসা! এই অনুভূতিগুলো বড়বেলায় বুঝেছি।
ছোটবেলায় মায়ের স্মৃতি মনে করলে যেটা মনে ভাসে, মায়ের কাঠের সিন্দুক। আমার কাছে মনে হত, তা যেন রুপকথার সাত রাজার ধন। মা যখন সিন্দুক খুলতেন, আমি তার তাঁতের শাড়ির আঁচল ঘেঁষে দাঁড়াতাম। আমার চাহিদা ছিল দুই-এক টাকা অথবা ৫০ পয়সা কিংবা ২৫ পয়সা। এই টাকা দিয়ে আমি হাওয়াই-মিঠাই কিনতাম। আমার ঠোঁট গোলাপি হয়ে যেত, বারবার তা আয়নায় দেখতাম।
কখনও খেতাম চীনাবাদাম কিংবা ফুরুলি বড়া। আহা, সেইসব দিন আর কি আসবে ফিরে! আমি যেন আজো আমার গ্রামীণ সোনালী শৈশব দেখতে পাই। কী আশ্চর্য, এখনো তা যেন সজীব, কোমল ও দুরন্ত!
পড়াশোনার হাতেখড়ি মায়ের হাতেই, মাটির চক আর স্লেট দিয়ে মা শেখালেন অ আ ক খ। স্মৃতিতে ভাসতে ভাসতে হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় আমি দেখি মায়ের মুখ, আমাকে নিখুঁত করে শেখানোর জন্য তার ছিল কি প্রাণান্তকর চেষ্টা।
মা ছিল আমার ফ্যাশন ডিজাইনার, পরামর্শক, সিদ্ধান্তদাতা। তবু কেনো যেন যত বড় হতে লাগলাম, মাকে ভয় পেতে থাকলাম। শুনেছি, বাবা-মা যে কোনো একজনকে কড়া হতে হয়। বাবা যেহেতু চাকরি করতেন, তাই এই গুরুদায়িত্ব মায়ের উপরই বর্তায়। দিনে দিনে মা শক্ত হাতে আমার পড়ার কাজ পরিচালনা করতে শুরু করলেন। আমি বই পড়ায় যত মনোযোগ দিতে থাকলাম, মায়ের শাসন যেন বাড়তে লাগলো। খেলাধুলার সময় কমতে থাকল।
এরপর থেকে মাকে ভয় পেতে শুরু করলাম। আমি তখনো প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি। বাবা ছুটিতে এলেই মায়ের নামে একরাশ অভিযোগ জানাতাম। বাবা ছুটি শেষে যেদিন চলে যেতেন, সেদিন বায়না ধরতাম, আমাকে তোমার ব্যাগের ভিতর ভরে সঙ্গে নিয়ে যাও। ব্যাগের ভিতর বাবার সঙ্গে যেতে চাওয়ার এই বিষয়টি নিয়ে বড় হবার পরেও অনেকে আমার সঙ্গে মশকরা করতেন।
অসুস্থতার দিনগুলোতে শুধু নয়, পরীক্ষার দিনগুলোতে মা নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিতেন। আমার হাতের লেখা যাতে ভালো হয়, সেজন্য বাদামের ঠোঙ্গা কিংবা কাগজের ঠোঙ্গায় কোনো ভালো হাতের লেখা পেলে মা সযতনে তা আমার হাতে তুলে দিতেন। আমি প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে প্রথম ছিলাম। এটি মায়ের অনুশাসন ও দিকনির্দেশনাই সম্ভব হয়েছে।
মায়ের অবদানের তুলনা হয় না। মা হলো আমার শান্ত নদীতে চলার দিশা, অশান্ত সমুদ্রে দক্ষ নাবিক। মূলত মা এমন করে গাইড করেছেন বলেই আজ আমি জীবনে একটা অবস্থানে এসে পৌঁছেছি। মায়ের শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ। তবু সেই শরীর নিয়ে মা আজো আমাকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মায়ের সিন্ধুসম ঋণের বিন্দুমাত্র ফেরত দিতে পারছি কি? নিজের কাছে এই প্রশ্ন করে যাই রোজ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজ, দিনাজপুর
ঢাকা/মেহেদী