ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

আমার দুই মা, দুই ভুবন

ফাহমিদুর রহমান ফাহিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪১, ১১ মে ২০২৫  
আমার দুই মা, দুই ভুবন

মাকে নিয়ে লিখতে বসে কলম যেন থমকে যায়। মা তো শুধু একটা শব্দ নয়, এ তো এক বিশাল পৃথিবী। মায়ের তুলনা শুধু মা-ই হতে পারে। আমার মাও ব্যতিক্রম নন। তবে আমার গল্পটা একটু অন্যরকম। আমার জীবনে মায়ের সংখ্যা দুজন। সম্পর্কে একজন আমার জন্মদাত্রী মা, আর অন্যজন আমার চাচি, যার স্নেহ আমার জীবনকে মায়ের মতোই আলোয় ভরে রেখেছে।

আমার জন্মের দেড় বছর পর আমার ছোট ভাইয়ের আগমন হয়। দুটি ছোট বাচ্চাকে একসঙ্গে সামলাতে মায়ের যখন হিমশিম অবস্থা, তখন আমার চাচি এগিয়ে আসেন। তার দুটি মেয়ে ছিল, একটি ছেলে জন্মের সময় মারা গিয়েছিল। সেই থেকে আমিই হয়ে উঠি তার তৃতীয় সন্তান; তার ছেলে। ছোটবেলায় আধো আধো বোলে আমি তাকে ডাকতাম ‘আটা মা’। আজ ২২ বছর বয়সেও সেই ডাক আমার মুখে লেগেই আছে।

আরো পড়ুন:

ছেলেবেলার কত স্মৃতি আজ ভিড় করে। সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে মনটা কেমন যেন এক স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে। আমার মনে পড়ে না কখনো তিনি আমাকে ধমক দিয়েছেন কিংবা জোর গলায় কথা বলেছেন। তার হৃদয় ছিল এতটাই কোমল আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ যে, তিনি সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন।

তবে আমার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল একটু বেশিই। ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম দুরন্ত, সারাক্ষণ ছুটে বেড়ানো আর মারামারি করা ছিল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। যখনই মায়ের কাছে আমার নামে নালিশ যেত, আর মা আমাকে মারতে উদ্যত হতেন, তখনই ত্রাতারূপে আবির্ভূত হতেন আমার ‘আটা মা’।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, মায়ের হাতে মার খেয়ে আমি প্রায়ই বাড়ির পাশের বাঁশবাগানে গিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। আর সেই সময় তিনিই ছুটে যেতেন, আমার হাত ধরে টেনে আনতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে শান্ত করতেন। যদিও আমি বড় হয়েছি তার কাছে, তবে আমার খাবার আসত আমার জন্মদাত্রী মায়ের কাছে থেকেই। কিন্তু ‘আটা মা’ কখনো আমাকে না খাইয়ে খেতেন না। সবসময় আমার জন্য ভালো ভালো অংশ তুলে রাখতেন। আমার পাশে বসে, না হয় পরে তিনি সেসব আমাকে দিতেন। রোজার মাসে আমার জন্য দু’বার ইফতারের আয়োজন থাকত—একবার মায়ের কাছে, আরেকবার ‘আটা মা’র কাছে। যেখানেই থাকি না কেন, আমার জন্য তিনি ইফতার প্রস্তুত রাখতেন।

আজ আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমার মা শহরে থাকেন, আর ‘আটা মা’ গ্রামে। আগে আমরা একই বাড়িতে থাকলেও পড়াশোনার জন্য শহরে চলে আসি। তবে গ্রামে গেলেই তার প্রথম প্রশ্ন থাকে, “কখন আসবি?” তিনি আমাকে আদর করে কখনো খোকা, কখনো মধু, আবার কখনো ফাহিম আলী বলে ডাকেন। আজও সেই ডাক শুনি। যখন আমি বাসা থেকে আসি, তার চোখের জল দেখতে পাই। প্রতিবার বিদায়ের সময় তিনি কাঁদেন, আমার জন্য নাকি তার অনেক চিন্তা হয়। এমন অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার দুই মায়ের সঙ্গে, যা লিখে শেষ করা যাবে না।

আমার জন্মদাত্রী মা-ও কোনো অংশে কম নন। আমরা তিন ভাই, আর তিনি তার তিন সন্তানকে বুক উজাড় করে ভালোবাসেন। সবসময় আমাদের আগলে রেখেছেন, আমাদের সব আবদার পূরণ করেছেন। কখন কী খেতে ইচ্ছে করছে, তা বলারও প্রয়োজন হয় না। এমনও হয়েছে, রাতে কোনো খাবারের তীব্র আকাঙ্ক্ষা মনে জেগেছে, কিন্তু মাকে বলিনি। সকালে উঠে দেখি সেই খাবার রান্না করে প্রস্তুত! এ যেন এক মায়াজাল, মায়েরাই হয়তো এমনই হন। তাদের ভালোবাসার স্পর্শে সবকিছু সম্ভব।

গত শীতে আমার জীবনের প্রথম উপার্জনের টাকা দিয়ে আমি আমার দুই মায়ের জন্য দুটি চাদর কিনেছিলাম। সেই উপহার পেয়ে তাদের যে আনন্দ হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিশেষ করে ‘আটা মা’র খুশি ছিল দেখার মতো। তিনি যেন সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাচ্ছিলেন, “দেখো দেখো, আমার ছেলে দিয়েছে!”

তাদের সেই আনন্দ দেখে আমার হৃদয় এক অন্যরকম ভালোলাগায় ভরে গিয়েছিল। হয়তো কখনো সরাসরি বলা হয়নি। তবে আজ এই লেখার মাধ্যমে আমি জানাতে চাই, “তোমাদের অনেক ভালোবাসি, মা।”

সবশেষে একটাই কামনা, পৃথিবীর সব মা ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আল্লাহ যেন সব মায়ের নেক হায়াত দান করেন, আমীন।

লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়