এনবিআরে আর নয়, কর অব্যাহতির ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে
বিশেষ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

রাজস্ব ভবন (ফাইল ফটো)
কর অব্যাহতির ক্ষেত্রে কঠিন অবস্থান নিয়েছে সরকার। অনির্দিষ্টকালের জন্য কোনো সংস্থা বা শিল্পকে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হবে না। এই সময়সীমা জন্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সর্ব্বোচ্চ ৫ বছরের জন্য এ সুবিধা দেওয়া হবে। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে শর্ত। এই শর্ত হলো, যে লক্ষ্যে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা অর্জিত না হলে বিদ্যমান অব্যাহতি সুবিধার সময়কাল আর বাড়ানো হবে না।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক ‘কর ব্যয় নীতিমালা এবং এর ব্যবস্থাপনা কাঠামো’তে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন খাতে করছাড় বা অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা এনবিআর’র কাছে আর থাকবে না। এই কর সুবিধা একমাত্র জাতীয় সংসদ দিতে পারবে। তবে জাতীয় সংসদ না থাকলে সেক্ষেত্রে এই সুবিধার দেওয়ার এখতিয়ার থাকবে রাষ্ট্রপতির হাতে। কর ব্যয় নীতিমালা এবং এর ব্যবস্থাপনা কাঠামোটি আগামী অর্থবছর অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।
কর ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে বলা হয়েছে- একটি সুষম ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক ও বিচারিক শাস্তির ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, যার মাধ্যমে অবৈধ সুবিধাভোগিদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা করা হবে।
কর ব্যয় নীতিমালা ও এর ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কর ব্যয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করা। কর ব্যয় নীতিমালাটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে, রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া সমতাভিত্তিক হবে এবং রাজস্ব খাতে যে সব অসম নীতি রয়েছে তা দূর হবে।’
কর ব্যয় অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের বিষয়ে কাঠামোতে বলা হয়েছে, বর্তমান আয়কর আইন, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন এবং কাস্টমস আইনের মাধ্যমে এনবিআরকে দেয়া কর অব্যাহতির ‘সব ক্ষমতা রহিত করা হবে’। বার্ষিক জাতীয় বাজেট প্রণয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন কর আইনসংশ্লিষ্ট যেকোনো ‘কর ব্যয় অনুমোদনের চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ হবে জাতীয় সংসদ’। আর সংসদ না থাকলে কর ব্যয়সংক্রান্ত বিধান জারির ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত থাকবে।
অন্যদিকে ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে (নিত্যপণ্য ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ)’ অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা জরুরি প্রয়োজনে মন্ত্রিপরিষদ বা উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে সাময়িক কর ব্যয় (অব্যাহতি) অনুমোদন করতে পারবেন। এভাবে অনুমোদিত কোনো কর ব্যয় যে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুমোদন করা হবে তার মেয়াদ কোনোক্রমেই জারির তারিখ থেকে সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের শেষ দিনের অতিরিক্ত হবে না। কোনো কর ব্যয়কে যে অর্থবছরে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ছাড় দেওয়া হয়েছে, সে অর্থবছরের পরও ওই কর ব্যয় কার্যকর রাখতে হলে তা জাতীয় সংসদের মাধ্যমে অনুমোদিত হতে হবে।
বর্তমানে প্রজ্ঞাপন বা আদেশের মাধ্যমে অনুমোদিত যেসব কর ব্যয়ের কোনো মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ নির্ধারিত নেই, সেসব কর ব্যয়সংশ্লিষ্ট সব প্রজ্ঞাপন বা আদেশ অর্থ মন্ত্রণালয় দ্বারা ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে বলে কর ব্যয় নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্ত অনুসারে সেসব কর ব্যয় অনুমোদন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কাঠামোতে আরও বলা হয়েছে, প্রতিবছর অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা জাতীয় সংসদে একটি বার্ষিক কর ব্যয় প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। প্রতিবেদনে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, কর ব্যয়ের বিস্তারিত বিবরণ এবং বিদ্যমান কর ব্যয়গুলোর মধ্যে প্রতি বছর কমপক্ষে এক-পঞ্চমাংশের ফলাফল মূল্যায়ন, যাতে প্রতিটি কর ব্যয়কে প্রতি পাঁচ বছরের মধ্যে কমপক্ষে একবার মূল্যায়ন করা হয় এবং তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়।
কর ব্যয় নীতিমালা এবং এর ব্যবস্থাপনা কাঠামোয় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা সত্তার নির্দিষ্ট আয়ের উৎসের বিপরীতে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আইনের মাধ্যমে করছাড় দেওয়া হলে সেই ব্যক্তি বা সত্তা পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো পদ্ধতিতে ওই নির্দিষ্ট আয়ের উৎসের বিপরীতে করছাড় প্রাপ্য হবেন না। এছাড়া ওই ব্যক্তি বা সত্তা যদি কোনো ধরনের একীভূতকরণ, বিভক্তিকরণ বা অধিগ্রহণের মাধ্যমে কাঠামোগত পরিবর্তন করেন, তাহলে তিনি বিদ্যমান করছাড় প্রাপ্য হবেন না। আন্তর্জাতিক কনভেনশন, দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, করসংশ্লিষ্ট কোনো চুক্তি, দ্বৈত কর পরিহার সংক্রান্ত কোনো চুক্তির আওতায় অনুমোদিত করছাড়গুলো এবং কর আইনগুলো এ নীতিমালার ওপর প্রাধান্য পাবে।
এ নীতিমালার আওতায় কর ব্যয় বলতে বিদ্যমান কর আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধি বিধান, যেমন এসআরও বা আদেশের মাধ্যমে প্রণীত বিভিন্ন আইনানুগ কার্যক্রমের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস ডিউটি, আয়কর ও আবগারি কর ব্যবস্থায় দেওয়া সব করছাড়কে বোঝাবে। তবে আয়কর আইন, ২০২৩-এর আওতায় উৎসে কর কর্তন বা সংগ্রহ অগ্রিম আয়কর বিধায় ওই উৎসে কর কর্তন বা সংগ্রহের হারের হ্রাস বা বৃদ্ধি কর ব্যয়ের আওতাভুক্ত হবে না।
আইনগত ভিত্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, কর ব্যয় নীতিমালা এবং এর ব্যবস্থাপনা কাঠামোর আইনানুগ বাস্তবায়নের জন্য সব কর ব্যয় সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো অর্থবিলের সঙ্গে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে। জাতীয় সংসদ কর ব্যয়গুলো অনুমোদনের পর যতদূর সম্ভব সংশ্লিষ্ট কর আইনগুলোয় তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অনুচ্ছেদ ৪.১ (গ)-এর ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে কেবল প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনোরূপ কর ব্যয় অনুমোদন করা যাবে না। তবে এক্ষেত্রেও জাতীয় সংসদে অনুমোদিত কর ব্যয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিবিধানগুলোর জন্য পৃথকভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করা যাবে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয় জাতীয় সংসদের কাছে বার্ষিক কর ব্যয় প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। কর ব্যয়ের কাঠামো নির্ধারণ, প্রাক্কলন ও পরিবীক্ষণের জন্য প্রতিটি কর ব্যয় সংশ্লিষ্ট কাঙ্খিত সীমা সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হতে হবে, যাতে এ বেঞ্চমার্কের বিপরীতে পরিমাপকৃত বিচ্যুতিগুলো সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
কর ব্যয় নীতিমালা কার্যকর হওয়ার পর নতুন করে কোনো কর সুবিধা সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে দেওয়া হলে তার মেয়াদ ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ব্যতীত পাঁচ বছরের অধিক হবে না। তবে জনস্বার্থে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের মাধ্যমে অনির্দিষ্টকালের জন্য অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া যাবে।
সাধারণভাবে কোনো কর সুবিধা সংক্রান্ত বিধিবিধানে উল্লিখিত মেয়াদকাল বৃদ্ধিকে নিরুৎসাহিত করা হবে। তবে নির্দিষ্ট মেয়াদকালের পরেও কোনো কর সুবিধার মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে কর সুবিধার কার্যকর ফলাফল এবং কর ব্যয়ের পরিমাণ পর্যালোচনার ভিত্তিতে সময় বৃদ্ধির আইনানুগ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
ঢাকা/হাসনাত/টিপু