সিএমএসএমই খাতে ঋণ প্রবাহ কম, লক্ষ্যভিত্তিক নীতি সহায়তার আহ্বান
ডিসিসিআই আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনার
শুল্ক ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা উল্লেখজনকহারে বাড়ার কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে। ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এর কারণে গত বছরের তুলনায় বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতি আরো বেশি মন্থর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সিএমএসএমই খাতের অভিজ্ঞতা ততটা ভালো ছিল না। কেননা উল্লেখিত সময়ে এ খাতে ঋণ বিতরণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২৩.৬ শতাংশ কমেছে। তাই সিএমএসএমই খাতের জন্য প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক নীতি সহায়তা।
রবিবার (২৪ আগস্ট) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ এই আহ্বান জানায় ঢাকা চেম্বার সভাপতি তাসকীন আহমেদ।রাজধানীর ঢাকা চেম্বার মিলনায়তনে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মঞ্জুর হোসেন।
তাসকীন আহমেদ বলেন,“সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পারষ্পারিক শুল্কারোপসহ বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বেসরকাররি খাতে ঋণ প্রবাহ হ্রাস, শিল্প খাতে জ্বালানি সরবরাহ অনিশ্চিয়তা, বিনিয়োগ স্থবিরতা, নানাবিধ দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে বেসরকারি খাতের অগ্রগতি তেমন আশাব্যঞ্জক নয় এবং এ অবস্থার আলোকে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্নের লক্ষ্যে আরো কিছুদিন সময় প্রয়োজন।
মূল প্রবন্ধে তিনি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত, সিএমএসএমই, তথ্য-প্রযুক্তি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, লজিস্টিক অবকাঠামো, দক্ষতা উন্নয়ন এবং আর্থিক খাতের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, “শুল্ক ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা উল্লেখজনক হারে বৃদ্ধির কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে। ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ২.৩ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।এর কারণে গত বছরের তুলনায় বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতি আরো বেশি মন্থর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
তিনি জানান, এলডিসি থেকে উত্তরণের বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে, ডিসিসিআই কমপক্ষে ৩ বছর এলডিসি উত্তরণ স্থগিত করার প্রয়োজন বলে মনে করে। যাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি, একটি শক্তিশালী ট্রানজিশন কৌশল বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট নীতিমালাগুলো হালনাগাদ সম্ভব হয়।
কর্পোরেট করহার বিশেষকরে অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক হওয়া উচিত বলে মনে করে ডিসিসিআই সভাপতি, যার কারণে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে না। তিনি আরো বলেন, “২০২৫ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং বিদ্যমান অবস্থার আলোকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা আনয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিমত জ্ঞাপন করেন, যাতে ব্যবসা-বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজীকরণ সম্ভব হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা দুর্নীতিমুক্ত একটা সমাজ চাই, অভ্যুথানের পর আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, তবে সেটি পাইনি। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে রিজার্ভসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার জন্য উদ্যোগ থাকলেও কর আহরণের পরিমাণ বাড়াতে এনবিআরকে আরো উদ্যোগী হতে হবে, যদিও এ ধরনের কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, বরং হয়রানি অনেকগুনে বেড়েছে।”
তাসকীন আহমেদ বলেন, “এলডিসি উত্তরণে আমরা ভীত নই, তবে বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং আভ্যন্তরীণ আন্দোলন বিক্ষোভ এবং সর্বশেষ ট্রাম্প কর্তৃক পারষ্পরিক শুল্ক আরোপের উদ্যোগ এ পরিস্থিতি আরো অসহনীয় করেছে। তাই আরো কিছুটা সময় পেলে আমরা নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারব এবং এ উদ্যোগে সরকারি-বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগ একান্ত অপরিহার্য।”
ডিসিসিআই সভাপতি উল্লেখ করেন, “আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে রপ্তানি ৩.০৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ৪৬.৮ শতাংশ। এমতাবস্থায় রপ্তানি ত্বরান্বিত করতে তিনি পণ্যের মূল্য সংযোজন, বৈচিত্র্যকরণ, নতুন বাজার অনুসন্ধান, সাপ্লাই চেইন সংযোগ বৃদ্ধি এবং বহুপাক্ষিক বাণিজ্য কূটনীতি ত্বরান্বিতকরণের উপর জোরারোপ করেন।”
২০২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সিএমএসএমই খাতের অভিজ্ঞতা ততটা ভালো ছিল না, কেননা উল্লেখিত সময়ে এ খাতে ঋণ বিতরণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২৩.৬% হ্রাস পেয়েছে। তাই সিএমএসএমই খাতের জন্য প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক নীতি সহায়তা—রাজস্ব প্রণোদনা, নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ, সাশ্রয়ী অর্থায়ন, বিনিময় হার স্থিতিশীলতা এবং সহজীকৃত কমপ্লায়েন্স—যাতে খরচ কমানো যায় এবং প্রতিযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানান ডিসিসিআই সভাপতি।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে তিনি সুদের হার হ্রাসের প্রস্তাব করেন তাসকীন আহমেদ, যা ২০২৪ সালের জুনে ১১.৫২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালের মে মাসে ১২.১১ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মঞ্জুর হোসেন বলেন, “দেশের ম্যাক্রো-ইকোনোমি কিছুটা হলেও স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে। রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের উন্নীত হয়েছে। যা স্বস্তির বিষয়। মূল্যস্ফীতি বেশ কমেছে, তবে চালের মূল্য ক্রমাগত বাড়ছে। তাই এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মূল্যস্ফীতি আরো কমতে পারে। তবে, মূল্যস্ফীতি না বাড়ানোর পাশাপাশি বিনিয়োগ যেন হ্রাস না হয়ে সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে।”
তিনি বলেন, “অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে গেছে, এমতাবস্থায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়োনোর কোন বিকল্প নেই।”
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলেও মূল্যস্তর বেশ উপরে চলে এসেছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতার অবনমনের এ বিষয়টি বেশ আশঙ্কার।”
তিনি উল্লেখ করেন, “বন্ডেড ওয়ারহাইস ও ব্যাংক-টু-ব্যাংক এলসি সুবিধার কারণে তৈরি পোশাক খাত আজকে এ পর্যায়ে এসেছে। তাই রপ্তানির সম্ভবানাময় অন্যান্য খাতগুলোকে এ ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক কথা হলেও তা দমনে কার্যকর তেমন কোন উদ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি। আমাদের এডিপি বাস্তবায়ন পুরোটাই চলছে ঋণের ওপর, যেটা কোনভাবেই টেকসই প্রক্রিয়া নয়। তাই অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও কর আহরণ বাড়ানোর ওপর বেশি হারে মনোনিবেশ করতে হবে।”
ড. মোস্তাফিজ আরো বলেন, “অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেও যোগাযোগ সংযোগসহ অন্যান্য সেবা প্রাপ্তিতে বেশ পিছিয়ে রয়েছি। এটার উন্নয়ন জরুরি।”
তিনি আরো বলেন, “এলডিসি পিছিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করা যেতে পারে। তবে আমাদেরকে প্রস্তুতির ঘাটতি রাখা যাবে না। যেন ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নে ঘাটতি না পড়ে। উন্নত দেশগুলোতে এসএমইরাই হলো মূল চালিকাশক্তি, তাই এ খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ শ্রমশক্তির তৈরিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।”
বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, “অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা মন্দের ভালো। অবস্থা উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য তা কাঙ্খিত নয়।”
তিনি উল্লেখ করেন, “দুর্নীতি যে খুব একটা কমেছে তা বলা যাবে না। অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। দুর্নীতির কারণে শুধুমাত্র বদলি দিয়ে শাস্তি দিলে হবে না। মানুষের ভিতরকার পরিবর্তন প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (মুদ্রানীতি বিভাগ) মাহমুদ সালাহউদ্দিন নাসের বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি এখন বেশ কঠোর বলে বেসরকারি খাতের অভিযোগ রয়েছে। তবে আমরা বেসরকারি খাতের সহনীয় পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছি।”
তিনি বলেন, সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না আসলে ব্যবসা পরিচালনা, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক (এসএমই ও স্পেশাল পোগ্রামস্ ডিপার্টমেন্ট) নওশাদ মুস্তাফা বলেন, “ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমে যাওয়া, জুলাই আন্দোলন এবং গত বছরের বন্যার কারণে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ ছিল না।”
এডিবির দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের অর্থনৈতিক কর্মকর্তা মো. রাবিউল ইসলাম বলেন, “আমাদের কে ট্রেড কানেক্টিভিটি বাড়ানো এবং রপ্তানি বাজারের সাথে এসএমইদের সংযোগ বৃদ্ধি এবং পণ্য পরিবহন খরচ হ্রাস করতে হবে।”
ঢাকা/নাজমুল/সাইফ