যশোরে বন্যায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
ফারুক || রাইজিংবিডি.কম
বি এম ফারুক, যশোর : টানা বর্ষণে যশোরের পাঁচটি উপজেলার অন্তত পাঁচশ’ গ্রাম ভেসে গেছে। বেরিয়ে গেছে শত শত ঘেরের মাছ। নষ্ট হয়েছে ফসলের ক্ষেত। এতে হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পানিবন্দি অবস্থায় এখনও মানুষ উঁচু বাধ ও রাস্তায় বাস করছে। এলাকার রাস্তা কার্যত জনশূন্য হয়ে পড়েছে। খেয়ে না খেয়ে কাটছে দুর্গতদের দিন-রাত। বন্যার কারণে বেনাপোল বন্দরে পণ্য উঠানো-নামানোয় ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।
ভবদহ অঞ্চলে মানুষের কান্না
যশোরের দুঃখ ‘ভবদহ’। এই এলাকায় প্রতি বছর বর্ষায় মানুষের দুর্দশার সীমা থাকে না। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি, শত শত মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বাস্তবায়ন না করায় যশোর ও খুলনা জেলার মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার ২৭টি বিলের পানি ভবদহ স্লুইসগেট দিয়ে নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান জানান, বন্যায় প্রাথমিকভাবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা। শিগগিরই ভবদহ স্লুইস গেটের সামনে পলি সরিয়ে পানি প্রবাহ সৃষ্টি করা না হলে এসব এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র মতে, ১৯৬১ সালে ভবদহ অঞ্চলে যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার আড়পাতা, বিল কপালিয়া, অভয়নগর উপজেলার দামুখালি, ভবানিপুর, দত্তগাতি, বারান্দি, চুমড়ডাঙ্গা ও খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার কাটেঙ্গা, চেঁচুড়ি, বরুণাসহ ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়।
১৯৮৬ সালে স্লুইস গেটের মুখে পলি জমে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যায় ভবদহ অঞ্চলের বিলপাড়ের কুলটিয়া, মশিয়াহাটি, মহিষদিয়া, পোড়াডাঙ্গা, সুজাতপুর, ডুমুরতলা, হাটগাছা, সুন্দলীসহ কয়েকশ’ গ্রামের মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবদহে স্লুইস গেটের সামনে নদী ও খালের মধ্যে বৃহৎ অংশ জুড়ে পলি জমে ৭-৮ ফুট উঁচু হয়ে গেছে। আর স্লুইসগেটের পেছনে বিল সংলগ্ন অংশ তা থেকে ৫-৬ ফুট নিচু।
কথা হয় কালিশাহকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (অব.) সুকুমার মণ্ডল, কৃষক বনমালি মণ্ডলসহ অনেকের সাথে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘টিআরএম না হওয়ায় পলি জমে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে বিলের পানি নিষ্কাশন না হলে চরম দুর্ভোগে পড়বেন তারা। ইতোমধ্যে মণিরামপুর উপজেলায় ১১ হাজার ৭৫০ হেক্টর আমন, আউশ, সবজি ও মরিচের ক্ষেত, ১ হাজার হেক্টর মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। অর্ধশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে পড়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী বৈকুণ্ঠ বিহারী রায় বলেন, ‘গত কয়েকদিনের ভারি বর্ষণে এলাকায় পানি জমে যায়। এই পানি ভবদহ স্লুইস গেট দিয়ে বের হচ্ছে না। স্লুইস গেটের সামনে নদী ও খাল পলিতে ভরাট হওয়ায় এমন হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা চলতে থাকলে শ্রী-হরি নদীর মোহনা খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার ঘ্যাংঘা হতে ৫০-৬০ কিলোমিটার উত্তরে যশোরের ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত, কোতয়ালি থানার কুয়াদা, নরেন্দ্রপুর, অভয়নগরের প্রেমবাগ, ধলেশিয়া, সুন্দলী, পায়রা, মণিরামপুর উপজেলার সিংহভাগ ইউনিয়নসহ প্রায় সাড়ে তিনশ’ গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়বে। এর ফলে বিপন্ন হবে পরিবেশ। দেখা দিতে পারে মানবিক বিপর্যয়।’
পায়রা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বিষ্ণুপদ দত্ত বলেন, ‘ভবদহের ২৬ ভেন্ট স্লুইস গেট হয়ে পানি শ্রী-হরি নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্তমানে শ্রী-হরি নদী পলি পড়ে ভরাট হওয়ায় পানি সরতে পারছে না এবং ভবদহ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
চলিশিয়া ইউপি চেয়ারম্যান নাদির মোল্যা বলেন, ‘ভবদহ অঞ্চলের মানুষকে বাঁচাতে হলে শ্রী-হরি নদী খনন ও টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।’
সুন্দলী ইউপি চেয়ারম্যান বিকাশ রায় বলেন, ‘ভবদহের সমস্যার কারণে প্রতি বছর সরকারকে রাস্তা মেরামতের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়। টানা বর্ষণে পানির তোড়ে ভেঙে গেছে অধিকাংশ কাঁচা ও পাকা রাস্তা। অবিলম্বে ভবদহের স্থায়ী সমাধান করা প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দিদের জন্য সরকারি ত্রাণ সহায়তার প্রয়োজন।’
পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি কমরেড গাজী আব্দুল হামিদ বলেন, ‘এলাকার মানুষের আন্দোলনে তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ড্রেজার ও স্ক্যাভেটর মেশিন দিয়ে পলি সরালেও তা কাজে আসেনি। সংগ্রাম কমিটির দাবি ছিলো, নদীতে জোয়ার-আধার সৃষ্টি করে পলি সরানো। তাহলে স্থায়ী জলাবদ্ধতার কবল থেকে ভূক্তোভোগীরা রক্ষা পেত।’
এ প্রসঙ্গে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, ‘কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে টিআরএম বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ২০১৪ অর্থবছরে বরাদ্দের টাকাও ফেরত যায়। ওই সময় ১৪৯ জন কৃষকের মাঝে ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণ করা হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় ৮ কোটি টাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পড়ে আছে। জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি না হওয়ায় ভবদহ স্লুইস গেট সংলগ্ন হরিনদী, শ্রীনদী ভদ্রা ও বিভিন্ন খাল পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পলি সরাতে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরে একটি প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সু-সংবাদ পাওয়া যাবে বলে আমরা আশাবাদি।
মানুষের চোখ আমডাঙ্গা খালে
ভবদহ অঞ্চলের মানুষ তাকিয়ে আছেন আমডাঙ্গা খালের দিকে। তাদের আশা, কর্তৃপক্ষ খালটি সংস্কার ও প্রশস্ত করবে। আর ভৈরবের মুখের সংকীর্ণ কালভার্টটি ভেঙে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করবে।
এক সময়ের ‘যশোরের দুঃখ’ ভবদহ অঞ্চলের দুই শতাধিক গ্রাম আবার জলাবদ্ধতা সমস্যার মুখোমুখি। চলতি সপ্তাহে টানা বৃষ্টিতে ৫০টির মতো গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে আরো দেড় শতাধিক গ্রাম।
ভবদহ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথ শ্রী-হরি নদী পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। শত শত কোটি টাকা খরচ করেও জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। অথচ তাদের (তৎকালীন ওয়াপদা) ভুল পদক্ষেপের কারণে যশোরের মণিরামপুর, অভয়নগর, কেশবপুর, খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা এবং সাতক্ষীরার তালা উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষকে বছরের পর বছর পোহাতে হয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ।
জলাবদ্ধতা নিরসনে এ অঞ্চলে বড় ধরনের আন্দোলনও হয়েছে। আন্দোলনরত জনতার দাবি মেনে নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড এক পর্যায়ে ভবদহ এলাকায় জোয়ারাধার বা টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) প্রকল্প চালু করে। কিন্তু তা নিয়েও নানা অভিযোগ থাকায় পরবর্তী পর্যায়ের জোয়ারাধার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি হয়।
শ্রী-হরি নদী পলি জমে ভরাট হওয়ায় আন্দোলনের মুখে সরকার আমডাঙ্গা খাল খনন করে। এই খাল দিয়ে ভবদহ এলাকার পানি ভৈরব নদে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন খালটি সংস্কার করা হয়নি। খালটি যথেষ্ট প্রশস্ত না হওয়ায় এবং ভৈরব নদের মুখে থাকা একটি সংকীর্ণ কালভার্ট উচ্ছেদ না করায় পুরো সুফল মিলছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে ভবদহ অঞ্চলে বড় ধরনের জলাবদ্ধতা দেখা দিলে পানি নিষ্কাশনের বিকল্প পথ হিসেবে আমডাঙ্গা খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এক বছরে এই প্রকল্প সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। পরের বছর ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে ‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি’ খালের পানি নিষ্কাশনে বাধা পেতে থাকা রেল ও সড়কের কালভার্ট ভেঙে দেওয়ার জন্য বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিয়ে তৎকালীন যশোর জেলা প্রশাসক অল্প সময়ের মধ্যে বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করে ওই দুটি কালভার্ট ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে সেখানে কোটি টাকা ব্যয়ে রেলওয়ে ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ওপর দুটি ব্রিজ নির্মিত হয়। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির দাবি ছিল খালটি প্রসারিত করে রাজাপুর খালের সঙ্গে সংযোগ দেওয়ার। পানি উন্নয়ন বোর্ড দুই দফা প্রকল্প গ্রহণ করেছে সে কাজ করার জন্য। কিন্তু জমি অধিগ্রহণে বাধার কারণে তা ভেস্তে যায় বলে দপ্তরটির কর্মকর্তারা বলেছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, খালটি মজে গেলেও কিছু পানি ভৈরবে নামছে। কিন্তু পানি নিষ্কাশনের সবচেয়ে বড় বাধা ভৈরবের কাছে মজুমদার অটো রাইস মিলের পাশে স্থাপিত ৬-৭ ফুট প্রশস্ত একটি কালভার্ট। কালভার্ট ভেঙে দিলে পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হবে বলে সকলেই মতামত প্রকাশ করেন।
ভবদহের ধোপাপাড়া গ্রামের কৃষক হরেকৃষ্ণ সরকার বলেন, ‘আমি কয়েক দিন আগে ওই কালভার্টটি ভেঙে দেওয়ার জন্য ইউএনও স্যারকে অনুরোধ করেছি। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন অল্প দিনের মধ্যে কালভার্টটি ভাঙা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়নি।’ কালভার্টটি ভেঙে দিলে প্রবল বেগে পানি নিষ্কাশিত হবে বলে হরেকৃষ্ণের অভিমত।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রিজিবুল ইসলাম জানান, কালভার্টটিতে পানি বাধা পাচ্ছে সত্য। কিন্তু এটি এখনো ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়নি। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি রণজিৎ বাওয়ালী বলেন, ‘আমরা গ্রামে গ্রামে সাংগঠনিক কার্যক্রম করছি। খুব শিগগির রাজপথে কর্মসূচি দেব। ২০০৬ সালের মতো বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিল কপালিয়ায় টিআরএম চালু ও আলমডাঙ্গা খাল প্রশস্ত করতে বাধ্য করা হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।’
মণিরামপুরে পাঁচ শতাধিক পরিবার রাস্তায়
গত তিন দিন বৃষ্টি না হলেও মণিরামপুরে পানি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং হরিহর নদীর পানি উপচে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকতে না পেরে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ শতাধিক পরিবার। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া লোকের দুর্ভোগ বাড়ছে।
এলাকাবাসী বলেছেন, সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি হাজারো মানুষ মানবেতর দিন কাটালেও ত্রাণ সাহায্য পৌঁছেছে সামান্যই। সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের আরো সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
যশোর-৫, মণিরামপুরের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘মানুষকে দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রালয়কে ইতোমধ্যে অবহিত করা হয়েছে।’
টানা বৃষ্টিতে মণিরামপুরের সব এলাকার খালবিল, ডোবা, পুকুর ভেসে একাকার হয়ে যায়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে উপজেলার ঝাঁপা, মশ্মিমনগর, হরিহরনগর, মনোহরপুর, দুর্বাডাঙ্গা, কুলটিয়া, হরিদাসকাটি, শ্যামকুড় ইউনিয়নসহ আশপাশের অনেক গ্রামের হাজারো পরিবার। বসতঘর ও রান্নাঘরে পানি উঠে যাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে রয়েছেন পানিবন্দি মানুষ। পানি জমে টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকটও দেখা দিয়েছে এলাকাগুলোতে।
এলাকাবাসী বলছেন, সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের। হরিহর নদীর পানি নামতে পারছে না। ফলে নদী উপচে পানি ঢুকে পড়েছে ইউনিয়নের চিনাটোলা, ফকির রাস্তা, হাসাডাঙ্গা, শ্যামকুড়, নাগোরঘোপ ও জামলা গ্রামের অনেক এলাকায়। এতে প্রায় ছয় হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘরের মধ্যে মানুষের পাশাপাশি আশ্রয় নিয়েছে সাপ, পোকা-মাকড়। পানিবন্দি হয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে ইউনিয়নের প্রায় বিশটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে পানি ঢুকে ধর্মীয় ক্রিয়াদি বন্ধ হয়ে গেছে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভেতরে হাঁটুপানি থাকায় চিকিৎসাসেবাও বন্ধ। এলাকার কোনো কোনো পাকা সড়কের ওপর দিয়ে প্রায় এক ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হওয়ায় ছোট যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে, পানি না কমে বরং বেড়ে যাওয়ায় উপায় না দেখে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সবকিছু নিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের দুই ধারে চিনাটোলা বাজার থেকে কেশবপুর পর্যন্ত ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক পরিবার বাঁশ, পাটকাঠি, পলিথিন দিয়ে ঘর বেঁধে আশ্রয় নিয়েছে।
উদ্বাস্তু হয়ে পড়া এসব মানুষ জানান, তারা এখনো পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণ বা সহযোগিতা পাননি। রাস্তায় অশ্রয় নেওয়া চিনাটোলা গ্রামের রোকেয়া বলেন, ‘বাড়িতে বুক সমান পানি। ৫-৬ দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। বাড়িতে টিকতে না পেরে পরিবার নিয়ে এখানে (রাস্তায়) আশ্রয় নিছি। এই পর্যন্ত কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি।’
সড়কে আশ্রয় নেওয়া খাদিজা নামে আরেক বয়োবৃদ্ধা বলেন, ‘ছেলে, বউ, নাতি-পুতিসহ ১৮ জনকে নিয়ে রাস্তায় উঠেছি। সকাল থেকে সবাই না খাওয়া। রান্না হচ্ছে, তারপর খাবো।’ রাস্তার অস্থায়ী বাসিন্দা বদিউজ্জামান বলেন, ‘সরকারি সহযোগিতা পাবো কি-না জানি না। তবে আশ্রয় নেওয়া লোকগুলোর জন্য অস্থায়ী কয়টি টয়লেট স্থাপনের দাবি আমাদের।’ এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতি হয়েছে কি-না জানতে চাইলে রাস্তার অস্থায়ী বাসিন্দারা জানান, ১৯৮৮ সাল ও ২০০৪ সালসহ এই নিয়ে তিনবার তাদের বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় আশ্রয় নিতে হয়েছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনি জানান, হরিহর নদীতে পলি জমায় ও পাটা থাকায় পানি নামতে পারছে না। বরং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ইউনিয়নের প্রায় ছয় হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এই পর্যন্ত প্রায় ৫০০ পরিবার রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে কষ্টে থাকলেও সম্মানের দিকে তাকিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিতে পারছেন না। কোনো সহযোগিতা দিতে পেরেছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমপি স্বপন ভট্টাচার্য্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু পরিস্থিতি দেখে গেছেন। তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
কেশবপুরের নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি
কেশবপুর পৌর এলাকাসহ নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় বাস করছে। উপজেলার পূর্বাঞ্চলের পাঁজিয়া ইউনিয়নের বাগডাঙ্গা ও মনোহরনগর, সুফলাকাটী ইউনিয়নের বেতীখোলা, আড়ুয়া, কালীচরনপুর, ময়নাপুর, কাটাখালী, সাগরদাঁড়ী, বগা, বিষ্ণুপুর, মহাদেবপুর, মেহেরপুর, গোবিন্দপুর ও বরণডালি, ত্রিমোহিনী, কোমলপুর গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এছাড়া অসংখ্য মাছের ঘের ও পুকুর ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে হাজার-হাজার বিঘা জমির ফসল।
অভয়নগরে মৎস্য খাতে ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি
টানা বর্ষণে অভয়নগর উপজেলার প্রায় অর্ধশত গ্রাম তলিয়ে গেছে। তিন হাজার ৬০০ হেক্টর (৭৭০টি) মাছের ঘের ভেসে গেছে। ডুবে গেছে প্রায় এক হাজার ৭০০ হেক্টর রোপা আমন ও সবজির ক্ষেত। শুধু মৎস্য খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া বেসরকারিভাবে ফসলের ক্ষতি হয়েছে আরও অন্তত ৩০০ কোটি টাকার।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রেমবাগ, সুন্দলী, চলিশিয়া, পায়রা ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম এবং বাঘুটিয়া, সিদ্দিপাশা ইউনিয়নের কয়েকটি অঞ্চল জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিচুর রহমান জানান, ভবদহ এলাকার সব মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে মৎস্যচাষিদের প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলা অফিসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানিয়ে তথ্য পাঠানো হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তা গোলাম সামদানী জানান, প্রায় এক হাজার ৭০০ হেক্টর রোপা আমন ধান ও সবজির খেত পানিতে ডুবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মূল্য নির্ধারণে কাজ করা হচ্ছে।
শিক্ষা অফিস জানিয়েছে, সুন্দলী ইউনিয়নের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীরা আসতে পারছে না। এছাড়া চলিশিয়া ইউনিয়নের বেদভিটা সরকারি প্রাথমিক, ডুমুরতলা সরকারি প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। এলাকার অনেক কাঁচা বাড়ি ও রাস্তা ভেঙে গেছে।
জলাবদ্ধ এলাকার মধ্যে রয়েছে ধলিরগাতি, বনগ্রাম কোটা, বাগদাহ, বলারাবাদ, আন্ধা, ডুমুরতলা, চলিশিয়া, বেদভিটা, দিঘলিয়া, সড়াডাঙ্গা, সুন্দলী, ফুলেরগাতি, ডহরমশিয়াহাটি, গোবিন্দপুর, হরিশপুর, কালিশাকুল, ভবানিপুর, রাজাপুরসহ ৪০টি গ্রাম। চরম দুর্ভোগে পড়েছে এসব গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। ভারী বর্ষণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় অনেক পরিবার তাদের পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করেছে। মৎস্য ঘের মালিকরা আহাজারি করছেন।
ধোপাদী গ্রামের মিজানুর রহমান জানান, প্রায় বিশ বিঘা জমিতে তিনি ঘের করেন। বৃষ্টির পানিতে সব ভেসে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ওই গ্রামের মৎস্যচাষি ইউছুফ আলী শেখ জানান, তিনি আড়তদারের কাছ থেকে মাছ বিক্রি বাবদ অগ্রিম এক লাখ টাকা নিয়েছেন। গত শুক্রবার মাছ ধরার জন্য জেলে ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু ঘের ভেসে সব মাছ চলে গেছে।
প্রেমবাগ গ্রামের ফারুক হোসেন জানান, তার ২০ বিঘার ঘেরে প্রায় ২০০ মণ মাছ ছিল। পানিতে ঘেরের সব মাছ চলে গেছে। টানা বর্ষণ ও দমকা হাওয়ায় এলাকার অনেক গাছপালা ভেঙে ও উপড়ে পড়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিড়ে পড়ায় এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে এখনও।
শার্শায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি
ভারী বর্ষণে শার্শার অর্ধশত গ্রাম এখনও তলিয়ে রয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমি ও দেড় হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। এক হাজার ৩০০ হেক্টর রোপা আমন ও সবজি ক্ষেতে পানি জমেছে। ৩৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বন্দর গোডাউনের একাংশসহ নিম্নাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। তবে এখনো সরকারি কোনো সহায়তা পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা। পানিতে তলিয়ে গেছে অনেক রাস্তা। সুষ্ঠু নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা ও অপরিকল্পিত ভেড়িবাঁধের কারণে কৃষিজমি তলিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ অনেকের। এছাড়া ভারত থেকে ভাটিতে নেমে আসা পানিও ঢুকে পড়েছে বেশ কিছু গ্রামে। সীমান্তনদী ইছামতির পানির চাপও দিন দিন বাড়ছে।
উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, শার্শার সীমান্তবর্তী শাখারীপোতা, বাহাদুরপুর, স্বরবাংহুদা, বোয়ালিয়া, মানকিয়া, রঘুনাথপুর, ঘিবা, ধান্যখোলা, মান্দারতলা, ডুবপাড়া, নটাদিঘা, হরিণাপোতাসহ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছে এসব গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার জানান, উপজেলার অধিকাংশ মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে মাছ চাষিদের ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এক হাজার ৩০০ হেক্টর রোপা আমন ও সবজি ক্ষেত পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রব বলেন, ‘উপজেলার প্রায় ৩৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জলাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীরা আসতে পারছে না।’
শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুস সালাম জানান, সার্বিক পরিস্থিতি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক শেখ ইমদাদ হোসেন বলেন, ‘বৃষ্টিতে সবজি, রোপা আমনসহ অধিকাংশ ফসলের ক্ষেত প্লাবিত হয়েছে। পানি সরে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হবে।’
যশোর জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ ফিরোজ খান বলেন, ‘জেলার অন্তত পাঁচটি উপজেলার কয়েক হাজার পুকুর, জলাশয় ও ঘের ভেসে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কয়েকশ’ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে।’
যশোরের জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষের মধ্যে ৫ লাখ টাকার শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সেই সাথে ৫০ টন চাল দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে আমরা ৩ লাখ টাকা পেয়েছি। এছাড়া মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে বন্যা দুর্গতদের যে সাহায্য আসবে তা বিতরণ করা হবে।’
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ আগস্ট ২০১৬/ফারুক/শাহনেওয়াজ
রাইজিংবিডি.কম