বাবা আমার আদর্শ শিক্ষক
সন্দীপন ধর || রাইজিংবিডি.কম
বাবা ১৯২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর বৃটিশ বাংলার সিলেট জেলার করিমগঞ্জ মহুকুমার বিয়ানিবাজারের কাশারী পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তার বেড়ে ওঠা পরবর্তিতে করিমগঞ্জ শহরে। তার প্রাথমিক পাঠ বিয়ানিবাজার পাঠশালায়। পরবর্তী সময় তার স্কুলজীবন কাটে কাছাড় জেলার তারাপুরে অবস্থিত নরমাল স্কুলে।
তিনি মনে প্রাণে বাঙালি ছিলেন। আরও দৃঢ়ভাবে বলতে গেলে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সিলেটি তার আচার আদর্শে। আমার জীবনের প্রথম এবং আমার জীবন গড়ে তোলার প্রতি যে আদর্শ শিক্ষকের অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন আমার বাবা। আমার জীবনের প্রথম পাঠদান বিশেষ করে সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা ও জ্ঞান তার কাছ থেকেই। এখানে তার শিক্ষাদানের কিছু ঘটনা তুলে ধরবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
১৯৬৯ সাল তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। সবেমাত্র প্রথম দিনে ইংরেজি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষা সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে প্রাতরাশ করতে করতে আমি কেবল বলেছিলাম, এই বছর স্কুলের পরীক্ষায় আমি যদি প্রথম স্থান অধিকার করি, আমায় তাহলে একটি নতুন বড় সাইকেল কিনে দিতে হবে। আমার বাবা সাথে সাথে আমার মাকে নির্দেশ দিলেন ওর ব্যাগ থেকে ওর টিফিনের বাক্সটা বের করে রেখে দাও, ওর আর পড়াশোনার দরকার নেই। অনেক আকুতি মিনতি করার পরেও সে বছর আমার আর পরীক্ষা দিতেদেননি বাবা। যে কারণে আমার ক্লাস সিক্সে পরের বছরেও থাকতে হয়েছিল। আমার বাবার বক্তব্য ছিলো, যে ছাত্র তার পড়াশোনার সাথে চাওয়া পাওয়াকে সংযুক্ত করে তার দ্বারা পড়াশোনা কেবল মাত্র কাগজ অর্জনের জন্য জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়।
আর একটি ঘটনা, ক্লাস সেভেনে ওঠার পরেই উনি আমার মাকে বলেছিলেন ওকে আসতে আসতে রান্না করা শেখাও। ও ছেলে বলে রান্না করতে পারবে না তা যেনো না হয়। কাল ও যদি বাইরে কোথাও যায় তখন ওর আজকের এই শিক্ষাটা কাজে লাগবে। প্রথম প্রথম রান্না করতে গিয়ে অনেক সময় হাতে গরম ছেকককা খেয়ে কিংবা হাতে বা গায়ে গরম তেল পরে কষ্ট পেয়েছি। মনে মনে বাবার প্রতি আমার ঘৃণা তখন জাগ্রত হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীকালে আমি যখন আমার উচ্চ শিক্ষার জন্য দিল্লি গমন করি, তখন আমার বাবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। তার সেই সময়কার শিক্ষাদানের কারণে যখন দেখতাম আমার অন্যান্য বন্ধু কিংবা সহপাঠীরা হোটেলের খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
যদিও বর্তমান সময়ের মতো তখনকার অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে এতটা চিন্তিত কিংবা উদগ্রীব থাকতেন কিন্তু তাদের নজর থাকতো সর্ব ক্ষেত্রে। আমার বাবা আমাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনার বিষয়ে কখনোই বেশি প্রশ্ন করতেন না। সে স্কুলজীবন থেকেই কিন্তু নজর রাখতেন সর্ব ক্ষেত্রে।
আমার আদর্শ শিক্ষক আমার বাবার আরও একটি ঘটনা উল্লেখ্য করতে চাই। ১৯৮৪ সালে আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একদিন আমায় ডেকে বাবা বললেন, এরপরে তোমার কি নিয়ে কোথায় পড়ার ইচ্ছা—সেই নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা করেছো। আমি জানাই, আমার ইচ্ছা পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে অধ্যায়ন করা। তার উত্তরে আমায় উনি প্রশ্ন করেন ওখানে কিভাবে ভর্তি হতে হয় এবং কতো শতাংশ নম্বর এর প্রয়োজন তার খোঁজ কি করেছো। আমি জানাই না, তোমাকে আমি বলতাম এক সঙ্গে একবার দিল্লি যাওয়ার জন্য, খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। উনি বলেন আমার হাতে এত সময় নেই পড়াশোনা যেহেতু তুমি করবে সেক্ষেত্রে সব দায়িত্ব তোমার। যা টাকা পয়সা লাগবে আমায় বলো আমার দ্বারা সম্ভব হলে আমি সেটা দেবো। সেইদিন মনে একরাশ অভিমান নিয়ে খোঁজখবর করে ট্রেনের টিকিট কেটে দিল্লি গিয়ে কলেজের খোঁজখবর নিয়ে আসি।
এক্ষেত্রে অবশ্য আমার শ্রদ্ধেয় এবং আমার পরবর্তী জীবন গঠনের ক্ষেত্রে যার একটি বড় অবদান, তার অধ্যাপক জশপাল এর অবদান ছিলো অপরিসীম। যিনি আমার জন্মদাতা পিতার পরে আমার আর এক পিতা। সেই প্রথম এক আঠারো বছরের কিশোরের একা একা দিল্লি যাত্রা তখনকার সময় যেটা প্রায় অনেক অভিভাবক চিন্তাই করতে পারতো না। পরবর্তীকালে আমি কলেজে ভর্তি হওয়া এবং মেস বাড়ি ঠিক করে ফেলার পাঁচদিনের মাথায় আমার বাবা আসেন আমার সঙ্গে দিল্লিতে সাক্ষাৎ করতে। তখন তিনি বলেন দেখো আজ যে তুমি আত্মনির্ভরশীল হতে পেরেছ সেটা সেইদিন আমার ব্যবহারের জন্য। সেদিন ওই কষ্টটা তোমায় না দিলে আজ তুমি পরজীবী হয়ে চলতে যা এখন তোমার বন্ধুরা করছে। আমার সেদিনকার ব্যবহার এবং তোমায় কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী। এই ছিল বাবার শিক্ষাদানের কায়দা।
বাবা সব ধর্মের প্রতি ছিলেন সহমর্মী কিন্তু একজন নিরিশ্ববাদি। তিনি কখনোই তার ইচ্ছা অনিচ্ছা তার সন্তান্দের ওপরে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেননি। কিন্তু আজ আমি গর্বের সাথে বলতে পারি তার আদর্শ এবং শিক্ষা আমার এই জীবনের পথচলায় এক অপরিসীম শক্তি। তিনি তাই গর্ব করে বলতেন আমার কন্যা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে যদিও সে মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসি, কিন্তু সেই আমার নিজের মেয়ে। আমার দুই পুত্রের সাথে আজ আমার এক মেয়েও আছে, আমার থেকে গর্বিত বাবা আর কয়জন হয়।
২০০৭ সালের ২১ জুন তার মৃত্যু হয়। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মৃতদেহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য দান করা হয়। কিন্তু তার এক সপ্তাহ পরে আমাদের পরিবারের উকিল এসে আমাদের দুই ভাইকে দেখায় যে তিনি তার মৃত্যুর ১০ বছর আগে এটি উইল করে গেছিলেন এবং সেখানে লেখা ছিলো তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার মৃত্যুর পরে তার মৃতদেহ দান না করা হলে যেন আমাদের দুইভাইকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য খরচ করা হয়।
তাই শেষ করার আগে যা আমি বলতে চাই, বাবার জন্য আমাদের অনুভূতি প্রতিদিনকার। বাবা আমাদের আদর্শ। কারো কাছে বাবা অনুপ্রেরণা। কারো কাছে গর্ব। সব মিলিয়ে আমাদের জীবনের সব জায়গাজুড়ে থাকেন বাবা। বাবাকে বিশেষভাবে একটা দিন খুশি করার জন্য বাবা দিবস উপলক্ষ মাত্র। তাই এ বছর বাবা দিবসে পৃথিবীর সব বাবার জন্য রইল শুভেচ্ছা।
আন্তর্জাতিক বাবা দিবসে এবং আমার বাবার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি পৃথিবীর সব বাবার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করলাম।
ঢাকা/সাইফ
রাইজিংবিডি.কম