ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বাবার স্মৃতিগুলো বেঁচে থাকার আত্মবিশ্বাস

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
বাবার স্মৃতিগুলো বেঁচে থাকার আত্মবিশ্বাস

‘বাবা’ একটি শব্দ ও দু’টি বর্ণের হৃদয়ের স্পন্দন। বাবাকে নিয়ে যত কথা, যত স্মৃতি সেটি কয়েক কোটি শব্দ দিয়েও পূরণ করার নয়। এইতো কিছুদিন আগেই চল্লিশ বছরপূর্ণ করে একচল্লিশে পা রাখলাম। একটা সময় বছরের পর বছর বাবার স্নেহ-মমতা আর কড়া শাসনের জালে বন্দি ছিলাম। আদর করলে খুশি হতাম, আর শাসন করলে মন খারাপ করতাম। আজ বুঝি, সেই শাসনটিও ছিল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।

অথচ আজ বাবার স্নেহ-ভালোবাসা আর শাসন করার মতো সেই মানুষটি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে, তারাদের দেশে। হঠাৎ একদিন আচমকা এক ঝড় সব কিছু ওলট-পালট করে দিল। বন্ধ হয়ে গেল বাবার হৃদস্পন্দন। মাথার উপর থেকে সরে গেল আগলে রাখা সেই বটবৃক্ষটি।

২০১৭ সালের ৪ মে বাবাকে হারালাম। মৃত‌্যুকে আলিঙ্গন করে কাঁদিয়ে গেলেন আমাদের। দেখতে দেখতে তিনটি বছর চলে গেল। কিন্তু আজও বাবার স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। বাকি জীবনের জন‌্য খুঁজে পাচ্ছি আত্মবিশ্বাস। বাবার সাথে আমার ৩৭ বছরের অনেক স্মৃতি যা হয়তো লিখে শেষ করা যাবে না। আবার কিছু স্মৃতি সারাজীবনের জন‌্য শক্তি জোগাবে।

আমি গর্ব করি আমার বাবাকে নিয়ে। তিনি এই দেশের স্বাধীনতার জন‌্য লড়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি বিজয় নিশান উঁড়িয়েছেন। আমার বাবা রবীন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালে ১১ নম্বর সেক্টরে কামালপুর রণাঙ্গণে বীরত্বগাঁথা রচিত করেছিলেন। অন‌্যায়ের বিরুদ্ধে উনার বলিষ্ঠ ভূমিকা সবসময় মানুষের প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। মৃত‌্যুর পর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে পেয়েছেন গার্ড অব অনার। এখনো তার সহযোদ্ধারা তাকে নিয়ে গল্প করে, একজন সন্তান হিসেবে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।

ছোট থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাবার হাত ধরে বড় হয়েছি। যখন বুঝতে শিখেছি তখন সকল আবদারের ভাণ্ডার ছিল বাবা। আর সন্তানের আবদার পূরণে বাবা ছিলেন সদা হাস্যজ্জ্বল।

বাবার সঙ্গে একটি ঘটনা আজও আমার মনকে নাড়া দেয়। সবেমাত্র যষ্ঠ শ্রেণিতে উচ্চ মাধ‌্যমিক বিদ‌্যালয়ে ভর্তি হয়েছি আমি। তখন বাবার কাছে বায়না করেছিলাম একটি বাইসাইকেল কিনে দেয়ার জন‌্য। কিন্তু আবদারের ধরনটি ছিল ভিন্ন রকম। কীভাবে বলব বাবাকে বাইসাইকেলের কথা, সেই নিয়ে ছিলাম ভীষণ চিন্তিত। অবশেষে বাইসাইকেল কিনে দেয়ার জন‌্য বাবার নিকট একটি চিঠি লিখলাম। বাবা ঘুমিয়ে ছিলেন, তাই চিঠিটা উনার চশমার নিচে রেখে দিলাম। চিঠির উত্তরের আশায় ওই মুহূর্তে বাবার খাটের নিচে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কখন বাবার ঘুম ভাঙবে,আর কখন চিঠিটা পড়বে। বাবা ঘুম থেকে উঠলেন এবং চিঠিটাও পড়লেন। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করে যথারীতি নিজ কর্মেও চলে গেলেন। কিন্তু আমি চিঠির উত্তর পেলাম না। মুখভার করে চলে গেলাম স্কুলে, সারাটা দিন স্কুল কাটালাম চুপচাপ। তারপর বাসায় এসে ঘরে ঢুকে দেখি নতুন চকচকে একটি ফনিক্স বাইসাইকেল। সারাদিনের গোমড়া মুখটিতে তখন ক্ষণিকের মাঝেই আনন্দের ঝিলিক দিয়ে উঠল। আর বুঝলাম বাবা এমনি হয়, সন্তানের বায়নাগুলো এভাবেই নিরবে-নিভৃতে পূরণ করে যায়। অথচ কাউকে বুঝতেও দেয় না। আজ আমিও দু’সন্তানের বাবা। আর বাবার মতন করে আমিও তাদের আবদারগুলো পূরণ করতে পারলে আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাই।

দায়িত্ব ও কর্তব‌্য পালনে বাবার কোনো তুলনা ছিল না। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে বাবা ছিলেন সাত ভাই ও তিন বোনের মাঝে সবার বড়। বাবা বড় ছেলে হিসেবে সবসময় ছোট ভাই-বোনদের আগলে রেখেছিলেন। কখনো কারো মনে এতটুকু আঁচ লাগতে দেননি। নিজেকে বিপন্ন করে হলেও, তার মায়ের কাছে দেয়া কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আমার কাছে আমার বাবা পুরো পৃথিবীর সেরা বাবা। কোনো দিবসে নয়, যতদিন বেঁচে আছি বাবাকে নিয়ে আমার প্রতিটিক্ষণ মধুময় হয়ে থাকবে।

বাবা লিখতে খুব পছন্দ করতেন। মূলত উনার কাছ থেকেই আমার লেখালেখির আগ্রহটা তৈরি হয়। তাই এ বিষয় নিয়ে বাবা-ছেলের সম্পর্কের অন‌্য একটা মাত্রা যোগ হয়েছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন বড় গল্প, ছোট গল্প, শিশুতোষ গল্প, কবিতা, ছড়া এবং সময়োপযোগী বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কলাম লিখতেন। দেশের বিভিন্ন স্বনামধন‌্য প্রিন্ট মিডিয়াতেও উনার লেখা ছাপা হয়েছে। আবার গরীব-অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও উনি অনেক লেখালেখি করেছেন। অনেক ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতেও মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে কথা বলেছেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাবার স্মৃতিগাঁথা কিছু গল্প আমায় বলেছিলেন, মাঝে মাঝে সেই গল্পগুলো মনে পড়ে। যুদ্ধকালীন ১১ নং সেক্টরের যোদ্ধা হিসেবে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলায় ২ দিন অভুক্ত থেকে যমুনা নদীর খরকা বিল সাঁতরিয়ে পার হয়ে বাবাসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তা নামে ১৬ বছর বয়সি এক ভিখারিনীর বাড়িতে আশ্রয় নেই। সে তার জমানো ভিক্ষার চাল দিয়ে ভাত রেধে তাদের খেতে দেন, কিন্তু সবার পেটে ভাত না জোটায় শেষে কাচামরিচ ও লবণ দিয়ে তারা ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন।

আরেকবার এলোপাতাড়ি প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৩০০ নারী-পুরুষকে একা দায়িত্ব নিয়ে নৌকা ও ভেলা দিয়ে গভীর রাতে যমুনা নদীর খরকা বিলের এপাড় থেকে ওপাড় পৌঁছে দিয়েছিলেন বাবা। বাবার জীবনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটি আরো একটি বড় ঘটনা ছিল।

বাবার একটা কথা আজও আমার কানে বাজে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উনি প্রায়ই বলতেন, আমি তো মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কিছু পাবার আশায় মুক্তিযুদ্ধ করিনি। তখন দেশমাতৃকার টানে নিজেকে দেশের জন‌্য উৎসর্গ করেছিলাম। কিন্তু এখন খারাপ লাগে, আজও নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ তো প্রতিদিন হয়নি, তাহলে কেন এমন তালিকা? মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা একবারই হওয়া উচিত, বারবার নয়। বাবা নীতি ও আদর্শে ছিলেন বলিয়ান। মৃত‌্যুর আগেও তিনি তার নীতিতে ছিলেন অটল।

তবে অবাক করার মতন বিষয় হচ্ছে, আমার চল্লিশ বছরের জীবনে বাবার সাথে মাত্র একবারই একটি প্রোগ্রামে বাবা ও আমি ফ্রেমবন্দি হয়েছিলাম। বাবার সাথে স্মৃতি অনেক, কিন্তু সেটি ছবির ফ্রেমে নয়, মনের ফ্রেমে। ২০১১ সালে সেই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছিলাম আমি, আর বাবা ছিলেন প্রধান অতিথি। অবশ‌্য বাবা ছবিতে বন্দি থাকতেও পছন্দ করতেন না। অথচ সেই বাবা আজ শুধুমাত্র ছবিতেই জীবমান।

বাবা তুমি যে আদর্শ ও নীতিতে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলে,আশীর্বাদ করো যেন তোমার সেই আদর্শ ও নীতি নিয়ে আমিও সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারি। ওপারে ভালো থেকো প্রিয় বাবা। খুব ভালো থাকো।

কিশোরগঞ্জ থেকে

 

ঢাকা/মারুফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়