‘চিলেকোঠার সেপাই’র স্রষ্টা
তানজিনা ইভা || রাইজিংবিডি.কম
তানজিনা ইভা : লেখনীতে সততা, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি, গভীর জীবনবোধের মতো বিরল গুণাবলি বাংলা সাহিত্যের যে কজন লেখক অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অন্যতম। চিলেকোঠার সেপাই -এর স্রষ্টা হিসেবে খ্যাত মহান এ মানুষটির ১৮তম প্রয়াণ দিবস আজ।
১৯৯৭ সালের ৪জানুয়ারি ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শক্তিমান এ লেখক। ষাটের দশকে লেখালেখি শুরু করে আমৃত্যু পর্যন্ত লিখেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যকে শক্তিশালী ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে গেছেন।
আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৪৩ সালের ১২ ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম মঞ্জু। পুরো নাম আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস। তার পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন। তার মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৪৯ সালে ঢাকার সেন্ট ফ্র্যান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে এ স্কুলটি ছেড়ে ঢাকার কেএল জুবিলি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। তৃতীয় শ্রেণিতে না পড়েই ১৯৫১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশুনা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে তার পরিবার ঢাকা থেকে বগুড়াতে চলে যায়৷ তখন আবার ইলিয়াসকে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়। বগুড়াতে গিয়ে তিনি ভর্তি হন বগুড়া জিলা স্কুলে। ১৯৫৮ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করার পর আবার ঢাকায় চলে আসেন তিনি এবং ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ইলিয়াস। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ১৯৬৪সালেইলিয়াসঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়থেকেবাংলাসাহিত্যেএমএপাসকরেন। জগন্নাথ কলেজে প্রভাষকের পদে যোগ দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
দুইটি উপন্যাস, কয়েকটি গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ সংকলন এই নিয়ে তার রচনাসম্ভার। সংখ্যার বিচারে নয়, তার লিখনশৈলীর স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বসাহিত্য সভায় স্থান করে নিয়েছেন তিনি আপন মহিমায়। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর পরেই তিনি সর্বাধিক প্রশংসিত বাংলাদেশি লেখক। তার প্রথম উপন্যাস চিলেকোঠারসেপাই পাঠক মহলে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৭৬ সালে প্রকাশ হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ অন্যঘরেঅন্যস্বর । প্রথম বই প্রকাশের ছয় বছর পর, ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ খোঁয়ারি। এরপর ১৯৮৫ সালে দুধভাতেউৎপাত, ৮৯-এ দোজখেরওম এবং মৃত্যুর পর পরই প্রকাশিত হয় তার শেষ গল্পগ্রন্থ জালস্বপ্ন, স্বপ্নেরজাল । একমাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থ সংস্কৃতিরভাঙাসেতু তারপরই প্রকাশিত হয়।
১৯৭৫ সালে, দৈনিকসংবাদ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে তার প্রথম উপন্যাস চিলেকোঠায় নামে। সরকারের রোষাণলের ভয়ে পত্রিকাটি তার লেখায় শব্দ পরিবর্তনের চেষ্টা করলে তিনি প্রতিবাদ করেন। এ কারণে লেখাটি আর প্রকাশিত হয়নি। পরে ১৯৮৬ সালে উপন্যাসটি চিলেকোঠারসেপাই নামে প্রকাশ পায়।
তার দ্বিতীয় উপন্যাস হলো খোয়াবনামা। উপন্যাসের ভাষা কীভাবে দেশের মানুষের মুখের ভাষার অনুবর্তী হয় তার দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন খোয়াবনামায়। এই উপন্যাসের সময়কাল বাঙালি জাতির বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পরের সময়কে ঘিরেই এই উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত। এটা সেই সময়ের কথা, যখন খরা আর অনাবৃষ্টিতে সারা বাংলার মাঠের ফসল জ্বলেপুড়ে যায়, ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বিভীষিকা গ্রাস করে এই বাংলাকে ।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা প্রসঙ্গে আহমদ ছফা বলেছেন , ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা অবশ্যই একটি মহাকাব্য। এই রচনার ব্যাপ্তি এবং পরিধি সমস্ত বাঙালি জাতির মর্মমূলকে স্পর্শ করেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে , কী ধরণের মহাকাব্য ? পরাজয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে কী মহাকাব্য রচনা সম্ভব? সবিনয়ে বলব, অবশ্যই সম্ভব। ইলিয়াসের খোয়াবনামা একটি মহাকাব্য ।’
বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য নানা পুরস্কার অর্জন করেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবির সংঘের হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, প্রফুল্ল কুমার সরকার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার, সাদাত আলী আকন্দ পুরস্কার এবং কাজী মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক লাভ করেন ৷ সাহিত্যে অবদানের জন্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ জানুয়ারি ২০১৫/ইভা/টিপু
রাইজিংবিডি.কম