ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

লালমাই-ময়নামতির মহাতীর্থ চন্ডীমুড়া

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ২৮ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লালমাই-ময়নামতির মহাতীর্থ চন্ডীমুড়া

মহাতীর্থ চন্ডীমুড়া সেবাশ্রম

ফেরদৌস জামান : মহাতীর্থ চন্ডীমুড়া সেবাশ্রমের কথা বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের কথা। এই পাহাড় সৃষ্টি নিয়ে রয়েছে কুমিল্লা অঞ্চলে একাধিক মুখরোচক কাহিনীর প্রচলন।

 

তার মধ্যে অন্যতম- লঙ্কার রাজা রাবণ সীতাকে হরণ করে নিলে রাম-রাবণের যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে রামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষণ শক্তিশেলের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন।

 

কবিরাজ নির্দেশ করলেন, যদি পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে ক্ষতস্থানে ’বিশল্যকরণী’ পাতার রস প্রয়োগ না করা যায়, তাহলে লক্ষণকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। আর ওই গাছ আছে একমাত্র হিমালয় পর্বত শ্রেণির গন্ধমাদন পর্বতে। যা কিনা লঙ্কাদ্বীপ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে। সুতরাং, এত অল্প সময়ের মধ্যে কোন মানবের পক্ষে তা সংগ্রহ করে আনা অকল্পনীয়।

 

পরিস্থিতি বিবেচনায় রামভক্ত পবননন্দন হনুমান আর বসে থাকতে পারলেন না। তিনি বায়ু বেগে উড়ে গেলেন হিমালয় পর্বতে। কিন্তু পর্বতে উপস্থিত হয়ে সে গাছ চিনতে পারলেন না। অগত্যা তিনি ’গন্ধমাদন’ পর্বতের যে স্থানে বিশল্যকরণী গাছ ছিল, সেই গোটা পর্বতটাকে মাথায় করে বয়ে আনলেন লঙ্কাদ্বীপে। ওষুধ পেয়ে লক্ষণ সুস্থ্য হয়ে উঠলেন।

 

এবার পর্বতটাকে যথাস্থানে রেখে আসার পালা। হনুমান পর্বত মাথায় করে আবার চললেন হিমালয় অভিমুখে। কুমিল্লা শহরের কাছাকাছি স্থানে ’লমলম’ সাগরের উপর দিয়ে চলার সময় সাগরের মনোরম শোভা দেখতে দেখতে তিনি কিছুটা আনমনা হয়ে পড়লেন। আর যায় কোথায়। পর্বতের ছোট একটি অংশ বিচ্যুত হলো। তারপর তা পড়তে পড়তে সাগরের এক প্রান্তে এসে পড়ে। যার নাম হয়ে গেল লালমাই পাহাড়।

 

এই গল্পের সমর্থনে পাহাড়ের নিচে যে মরা নদীর খাত রয়েছে, তাকে ‘লমলম’ সাগর বলে অভিহিত করা হয়। স্থানীয় প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা যায়। আর সেই পাহাড়েরই দক্ষিণ প্রান্তদেশে মহাতীর্থ চন্ডীমুড়া সেবাশ্রমের অবস্থান।

 

আশ্রমের পুরোহিতের কাছে প্রকৃত ইতিহাস জানতে চাইলে তিনি গভীর মনোযোগ ও আবেগের সঙ্গে আবৃত্তি করেন-

 

‘চম্পক রায় দেওয়ান ছিল ’হইল’ যুবরাজ,/ তাহার ভগ্নি দুতীয়া দেবী করে পূণ্য কাজ।/মেহের কুল উদয়পুর দির্ঘীকা খনিল, /দৌল সেতু চন্ডীমুড়া চন্ডীকা স্থাপিল।’

 

তারপর বললেন, খৃষ্টিয় সপ্তম শতকে বৌদ্ধরাজ দেবখড়গের স্ত্রী প্রভাবতী দেবী অমর কীর্তি স্থাপনে বদ্ধ পরিকর হয়ে পাশাপাশি দুইটি মন্দির স্থাপন করেন। একটি শ্রী শ্রী চন্ডী মন্দির, যাতে স্থাপন করেন ’অষ্টভুজা সর্বাণী মহা সরস্বতি’ প্রতিমা এবং অপরটি শিব মন্দির। সবশেষে অদূরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এক বিশাল দিঘী খনন করেন। এরপর নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে কালের আবর্তে মন্দির দুটি হারিয়ে যায়। অর্থাৎ, মাটি ও গাছপালায় ঢেকে যায়। অবশেষে গত শতকে ’শ্রীমৎ আত্মানন্দ গিরি’ মহারাজ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পরিত্যাক্ত মন্দির দুটি উদ্ধার করে পূণঃসংস্কার করেন। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে পুরোহিতের দেওয়া তথ্যের মিল পাওয়া যায় পন্ডিতদের অভিমতেও। তাদের মতে এটি পালযুগে নির্মিত। 

 

লালমাই পাহাড়ের সর্ব দক্ষিণ প্রান্তদেশের চুড়ায় মন্দিরের অবস্থান। এঁকেবেঁকে শত সিঁড়ি কেটে সেখানে উঠতে হয়। চুড়ায় ঝকঝকে তকতকে পাকা প্রাঙ্গণের পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশাপাশি দুটি ছোট ছোট মন্দির। প্রত্যেকটির আয়তন ৩.৬৩ বাই ৩.৬৩ মিটার এবং উচ্চতা ৪.৫৪ মিটার।

 

গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুণ্যার্থীরা এসে জড়ো হয়েছে। সঙ্গে করে প্রসাদ ও অর্ঘ্য’র পাশাপাশি নিয়ে এসেছে নিজেদের আহারাদি। আবার কেউ কেউ সেখানেই রান্না করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিচ্ছেন। মন্দিরে অর্ঘ্য প্রদানের পর খাবার শেষে নির্দিষ্ট স্থানে বিশ্রামের পর বিদায় হচ্ছেন যে যার মতো।

 

পুরোহিত মহাশয় জানান, শুধু দেশের নানা জায়গা থেকে নয় বিদেশ থেকে বিশেষকরে পার্শবর্তী দেশ ইন্ডিয়া থেকেও অনেক পূণ্যার্থী এখানে আসেন।

 

প্রসঙ্গত. মন্দিরের উত্তর দিকে প্রায় বিশ মিটার দূরে একটি ঢিবি আছে। যেখানে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ লুকায়িত আছে। আবার সেখান থেকে প্রায় চল্লিশ মিটার দূরে অন্য আর একটি ঢিবি দেখা যায়। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা এই ঢিবির নিচেও একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এই দুই স্থান থেকে প্রাপ্ত ইটের নমুনা থেকে এমন ধারণা করা হয়। গবেষক ও পন্ডিতগণও একই ধারণা পোষণ করেন।

 

অন্যান্যদের মত পুরোহিত মহাশয়ও মনে করেন, ইতিহাস ঐতিহ্যের রক্ষা ও এখানকার প্রত্নতত্তকে সমৃদ্ধ করতে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তর উক্ত স্থাপনাগুলি উদ্ধার করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে।  

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ নভেম্বর ২০১৫/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়