বৈচিত্র্যময় ও সমস্যাসংকুল বেদের জীবন যাপন
|| রাইজিংবিডি.কম
বেদের জীবন যাপন
রফিক সরকার
রংপুর, ৭ অক্টোবর: ‘ও রানী সালাম বারে বার, নামটি আমার জ্যোৎস্না বানু রানী থাকি লক্ষ্যার পাড়, মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি-বারি আরেক ঘাটে খাই, মোধের সুখের সীমা নাই, পথে ঘাটে লোক জমাইয়া মোরা সাপ খেলা দেখাই, ও মোদের সুখের সীমা নাই।’
এটি প্রয়াত চিত্রপরিচালক তোজাম্মেল হক বকুলের এক সময়কার বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ব্যবসা সফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ ছবির গান। আর এই বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না ছবিটি ছিল বেদেদের জীবন নিয়ে নির্মিত।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও সমস্যাসংকুল হলো বেদে সম্প্রদায়ের জীবন। এরা মূলত আমাদের দেশে বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত একটি ভ্রাম্যমান জনগোষ্ঠী। অনেক সময় এরা যাযাবর নামেও পরিচিত হয়ে থাকে।
কথিত আছে, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকান রাজার সঙ্গে এরা ঢাকায় আসে। পরে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। এরা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে এবং পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও ছড়িয়ে পড়ে।
তাদের আদি নাম মনতং। বেদে নামটি অবজ্ঞাসূচক বাইদ্যা, পরিমার্জিত ‘বৈদ্য’ থেকে উদ্ভূত। অধিকাংশ বেদেই হাতুড়ে চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে অভিহিত হয়।
বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। তাই তারা নিজেদের মনতং বলে পরিচয় দিতে বেশি আগ্রহী। যুদ্ধ ও শিকারে অতিশয় দক্ষ বেদেরা কষ্টসহিঞ্জু ও সাহসী। তাদের গাত্রবর্ণ ও আকৃতি বাঙালিদের মতো।
বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষার নাম ঠেট বা ঠের। স্বগোত্রীয়দের সাথে কথা বলার সময় এরা এই ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তবে বাংলা ভাষা-ভাষীর সঙ্গে তারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করে।
উল্লেখ্য এই ঠেট ভাষার সঙ্গে আরাকানদের ভাষার মিল আছে। তাদের ভাষায় ব্যবহৃত অধিকাংশ শব্দই বাংলা ভাষার আদি রূপ প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত। বেদেরা কৌম সমাজের রীতিনীতি মেনে চলে ও দলবদ্ধ হয়ে থাকে।
গোত্রপ্রীতি প্রবল বলে সদস্যরা একে অন্যকে নানাভবে সাহায্য করে থাকে। বেদেদের সমাজ পিতৃপ্রধান হলেও মেয়েরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বেদে ছেলেরা অলস প্রকৃতির। সব রকমের কঠোর পরিশ্রম মেয়েরাই করে থাকে। বেদেরা সাধারণত সমতল ভূমিতে নদী-নালার আশপাশে দলবদ্ধভাবে মাচা তৈরি করে অথবা নৌকায় বাস করে।
তাছাড়া জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম এরা নৌকাতেই সেরে থাকে। নৌকাই সাধারণত তাদের আবাসস্থান এবং একমাত্র অবলম্বন।
কোনো নদী বা খালের কিনারায় সারি সারি ছোট ছোট অসংখ্য ছইওয়ালা নৌকা বাধা থাকলে বোঝা যায় এগুলো বেদে নৌকার বহর।
নৌকাই তাদের জীবন-জীবিকার সব। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এক নগর থেকে আরেক নগরে ঘুরে বেড়ায় নৌকা দিয়ে। তাই নৌকা তাদের জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ।
বেদেরা সাপ ধরে খেলা দেখায় এবং সাপের বিষ বিক্রি করে। এছাড়া তারা তাবিজ-কবজও বিক্রি করে। বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তারা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে পরিভ্রমণ করে। এই পরিভ্রমণকে বেদেদের ভাষায় গাওয়াল বলে। মহিলারাই বেশী গাওয়ালে যায়।
তাদের সঙ্গে থাকে সাপের ঝাঁপি বা ঔষুধের ঝুলি। এরা সপরিবারে গাওয়ালে যায় শীতের শুরুতে অগ্রাহায়ন মাসের শেষের দিকে ও আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ার্ধে।
প্রথম দফায় চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ও দ্বিতীয় দফায় আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় এরা গাওয়াল করে। গাওয়ালের সময় এরা স্থানীয়ভাবে মূলত নৌকা, তাঁবু বা কোনো স্কুল ঘরের বারান্দায় সপরিবারে থাকে।
গাওয়াল শেষে দলবদ্ধভাবে আবার স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে আসে। গাওয়ালে তারা হেটে যায় কিংবা নৌকা ব্যবহার করে।
বেদেনীরা যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় তখন পুরুষ বেদেরা নৌকায় থেকে তাদের ঘর-সংসার, ছেলেমেয়ে দেখাশোনা করে। বেদেনীরা দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন গ্রাম, পাড়া বা মহল্লায় ঘুরে ঘুরে কাচের চুড়ি, কানের দুল, ফিতা, সাবান, নাক ফুল, রুলি ইত্যাদি বিক্রি করে আয়-রোজগার করে।
স্থায়ী আবাসে ফিরে বেদেরা সাধারণত বিভিন্ন আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করে। এসব উৎসবেই বর-কনে পরস্পরকে পছন্দ ও অভিভাবকের সম্মতিতে বিয়ে করে। বিয়ের ব্যপারে যুবক-যুবতীর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে।
তবে বেদেদের বিচিত্র জীবনের সবচেয়ে অদ্ভূদ দিক হলো তাদরে বিয়ের অনুষ্ঠান। বিয়ের দিন বর নির্দিষ্ট একটা উঁচু গাছের ডালে বসে থাকে।
কনে গাছের নিচে এসে বরকে গাছ থেকে নেমে আসার জন্য আনেক অনুনয়-বিনয় করে, কিন্তু বর সহজে নেমে আসতে চায়না। এরপর কনে তাকে নানা প্রলোভন দেখায়। তাতেও বরের মন না গললে হবু স্বামীকে সারা জীবন আয়-রোজগার করে খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয় এবং এরপর হবু বর গাছ থেকে নিচে নেমে আসে।
বেদেনী বিয়ের সময় দেয়া প্রতিশ্রুতি সারা জীবনই পালন করার চেষ্টা করে। বেদেদের বিয়ে সহজে ভাঙে না এবং বিয়ের রেজিষ্ট্রিও করা হয় না। তবে তাদের সমাজে বহুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহের রেওয়াজ সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু যৌথ পরিবার প্রথা নেই বললেই চলে। বিধবা বিবাহে কোনো বাধা নেই। বেদেদের মধ্যে যারা একটু শৌখিন ও সচ্ছল তারা নিজেদের জন্য খুব সুন্দর নৌকা তৈরি করে। এসব নৌকা তারা বিচিত্র রং দিয়ে মনের মতো করে সাজায়।
বেদেদের প্রতিটি পরিবারে নিজস্ব নৌকা থাকে। কয়েকটি পরিবার ও নৌকা নিয়ে হয় দল, আর কয়েকটি দল নিয়ে হয় বহর। কয়েকটি বহর নিয়ে গঠিত হয় উপগোত্র। বহরের দলপতি সরদার নমে পরিচিত। সরদার তার বহরকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে প্রতিটি দলে একজন করে পরিচালকের মাধ্যমে কাজ পরিচালনা করেন।
সরদার প্রতিটি দলের বাণিজ্যপথ এলাকা নির্ধারণ করেন, যাতে দলের অন্যান্য সদস্য প্রয়োজনের সময় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
তবে বহরের প্রশাসনিক ও নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব সরদারের। সরদার নিয়ম ভঙ্গকারীকে শাস্তি দেন ও বিভিন্ন বিরোধের সাক্ষ্য প্রমাণ বিশ্লেষন করে রায় দেন।
বিচারকার্যের শুরুতেই বাদি-বিবাদি উভয় পক্ষকে জামানত হিসেবে সরদারের কাছে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ গচ্ছিত রাখতে হয়। বিচারে যে হেরে যায় তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এই বাজেয়াপ্ত অর্থ খরচ করে বহরের লোকদের খাওয়ানো হয়।
অন্যদিকে পূর্বনির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো দল গাওয়াল থেকে স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে আসতে ব্যর্থ হলে সরদার কৈফিয়ত তলব করে শাস্তি দিতে পারেন। সরদারের ভরণপোষণের দায়িত্ব বহরের।
বেদে সম্প্রদায়ের কারো বিয়ে হলে সরদারকে বিশেষ ফি দিতে হয়। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানেও সরদার উপহার পেয়ে থাকেন।
তবে বহরের জন্য যেমন সরদার আছেন, ঠিক তেমনি আছেন উপগোত্রীয় ও গোত্রীয় সরদার। বছরে একটি সমযে পূর্বনির্ধারিত স্থানে বহরের সরদাররা মিলিত হয়ে উপগোত্রীয় ও গোত্রীয় সরদার নির্বাচন করেন।
আগে মুন্সীগঞ্জের কছে গঙ্গা-ব্রহ্মপূত্রের সঙ্গমস্থলে কৃতিক বারুনীর স্নান উপলক্ষে যখন এক মাস স্থায়ী মেলা বসত, তখন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সব বহরের সরদাররা এখানে এসে মিলিত হতেন এবং উপগোত্রীয় ও গোত্রীয় সরদার নির্বাচিত করতেন।
বর্তমানে বেদেরা প্রতি বছর কার্তিকের ৫ তারিখ হতে অগ্রহায়ণ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে একত্রিত হয় মুন্সীগঞ্জ ও চট্রগ্রামে। তখন নির্বাচন হয় ও সারা বছরের জমে থাকা সব বিবাদ বিরোধ মিটিয়ে ফেলা হয়।
তবে বহরের একজন সরদারের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার সরদারি বজায় থাকে। তার মৃত্যুর পর নতুন সরদার নির্বাচিত হন। সহজ-সরল জীবনযাপনকারী বেদেরা খুবই সৎ প্রকৃতির। অপরাধ করে গুরতর শাস্তির ভয় থাকলেও সরদারের কাছে অপরাধ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না।
বাংলাদেশের বেদেরা মোট ৯টি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হলো- লাউয়ো বা বাবাজিয়া, চাপাইল্যা, বাজিগর, বেজ বা মিচ্ছিগিরি, গাইন, মেল্লছ, বান্দাইরা, মাল এবং সাপুড়িয়া। কারো জমিতে কায়িক পরিশ্রম করাকে এরা অমর্যাদার কাজ বলে মনে করে। তাদের সর্বজনীন পেশা হলো চিকিৎসা ব্যবসা ও ঔষুধ বিক্রি।
নানারকমের বুনো লতাপাতা আর শেকড়-বাকড় এরা ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মন্ত্র অর্থাৎ ঝাড়-ফুঁকের প্রয়োগ অত্যন্ত বেশি। এরা জড়িবুটি দিয়ে শিশু চিকিৎসা, বাত ও দাঁতের ব্যথা, মালিশ প্রভৃতিতে অভিজ্ঞ বলে বিশ্বাস প্রচলিত আছে।
এরা নানা ধরনের খেলা দেখায়, উল্কি পরায় ও দৈহিক কসরত প্রদর্শন করে।
বেদেদের জীবনের একটি অন্যতম দিক হলো পাখি শিকার করা। এটি অবশ্য বেদেদের প্রধান শখ। তাদের পাখি শিকার করার কৌশলও বিচিত্র।
পাখি শিকারের জন্য ব্যবহার করা হয় সরু ও মোটা আকৃতির নল। এ নল এমনভাবে তৈরি হয় যেন প্রয়োজনে ছোট এবং বড় করা যায়। এ নলের মাথায় থাকে একটি শর।
আবদুল্লাহপুর, মীর কাদিম, চিতলীয়, মকহাটি টঙ্গীবাড়ী, দিদায় মুম্মীরহাট, কালীগঞ্জ খেয়াঘাট প্রভৃতি এলাকায় এক সময় কয়েক হাজার বেদে পরিবার বাস করত। এসব অঞ্চল থেকে কিছু বেদে চলে যায় সুনামগঞ্জের সোনাপুর এলাকায় ও সাভারের ভাটপাড়া এবং কালীগঞ্জের বক্তারপুর গ্রামে।
বর্তমানে সাভার ‘ভাটপাড়া ও বক্তারপুর গ্রামে কয়েকশ’ বেদে পরিবার বসবাস করছে। তাছাড়া পূবাইল ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, মোহনগঞ্জ ও ইটনায় রয়েছে বেদে সম্প্রদায়ের বিশাল জনোগোষ্ঠী।
রাইজিংবিডি / রফিক সরকার / এলএ
রাইজিংবিডি.কম