ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

উপকূলে প্লাবন, ম্লান পানিবন্দি মানুষের ঈদের আনন্দ

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৫ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উপকূলে প্লাবন, ম্লান পানিবন্দি মানুষের ঈদের আনন্দ

রফিকুল ইসলাম মন্টু, উপকূল ঘুরে : উপকূলবর্তী জেলাসমূহে নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক বেড়েছে। কোথাও বেড়িবাঁধ ধ্বসে গেছে, কোথাও বিধ্বস্ত বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে বাড়িঘরে। অনেক স্থানে জোয়ারের পানি ঠেকাতে নেই বেড়িবাঁধ। ফলে উপকূলের নিচু এলাকার বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। বহু মানুষ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। অমাবশ্যার এই প্লাবন বছরে বেশ কয়েকবার দেখা দিলেও জোয়ারের চাপ ও পানির উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

 

সূত্র বলেছে, গত দু’দিনে পূর্ব মধ্য ও পশ্চিম উপকূলের নিচু এলাকাগুলো জোয়ারের পানিতে ডুবেছে। মধ্য উপকূলের ভোলার নিম্নাঞ্চলের অন্তত ৩০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি। তজুমদ্দিন উপজেলা সদর দিনে দু’বার জোয়ারের পানিতে ডুবছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালীর নিচু এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি। এছাড়া লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকার মানুষ জোয়ারের পানির কারণে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। এমতাবস্থায় প্লাবিত এলাকায় ঈদের খুশি ম্লান হয়ে পড়েছে। 

 

গত রোববার দুপুরে হঠাৎ জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায় ভোলার নিম্নাঞ্চলে। আকস্মিকভাবে প্লাবিত হয় ৩০ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। এতে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট এমনকি বিভিন্ন স্থাপনা তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ভোলা সদরের ইলিশা, রাজাপুর, দৌলতখানের হাজিপুর, নেয়ামদপুর, মেদুয়া, ভবানীপুর, মনপুরা উপজেলার মনপুরা ও হাজিহাট ইউনিয়নের কাউয়ারটেক, আন্দির পাড়, দাসেরহাট, নাইবেরহাট, সোনার চর, পূর্ব আন্দির পাড় ও কলাতলীর চর, তজুমদ্দিন উপজেলার চাদপুর, মহাজনকান্দি, হাজিকান্দি, দরিচাঁদপুর, কেয়ামূলা, বালিয়াকান্দি ও ভুলাইকান্দি এবং চরফ্যাশন উপজেলার কুকরী-মুকরী, ঢালচর, চর পাতিলা, মাদ্রাজের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

 

ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. ইউনুস জানিয়েছেন, রোববার মেঘনার পানি বিপদসীমার তিন দশমিক ৭২ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়। দুপুরে অস্বাভাবিকহারে পানি বৃদ্ধির কারণে বোরহানউদ্দিন ও দৌলতখানের কয়েকটি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 

এক মাস ধরে জোয়ারের পানিতে ভাসছে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার অন্তত ২০ গ্রাম। দিন রাতে দুই বার এসব গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। এতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। চলতি রমজান আর ঈদ সামনে রেখে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের চৌমুহনী ও হাজিকান্দি গ্রামে মেঘনা নদীর ভাঙ্গনের ফলে সেখানে বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ধাক্কায় ওই স্থান দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকেছিল। এবারের জোয়ারেও ঝুঁকিতে পড়েছে উপজেলা সদর, চাঁদপুর, কেয়ামুল্যা, হাজিকান্দি, আড়ালিয়া, পাটওয়ারী কান্দি, দড়ি চাঁদপুর, দালাল কান্দি, শশিগঞ্জ, ভুলাই কান্দি, ভুইয়া কান্দি, দেওয়ানপুর, বালিয়া কান্দি, সিকদার কান্দি, মহাজন কান্দিসহ অন্তত ২০টি গ্রাম। অমাবশ্যার কারণে নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৪ ফুট পানি বেড়েছে।

 

 

শুকনো মৌসুমে ঝুকিপূর্ণ এসব এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ না করায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পানিবন্দী মানুষ। ভোলা উপজেলা সদরে বসবাসরত প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রফিক সাদী বলেন, ‘নদীতে পানির উচ্চতা ৩-৪ ফুট বেড়েছে। এতে ঘরের মেঝেতে প্রায় ২ ফুট পানি উঠেছে। জোয়ার এলেই চৌকির উপর উঠতে হয়। পানির নিচে চুলা ডুবে থাকায় রান্না করতে না পেরে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।’

 

উপজেলা সদরের পানিবন্দি বাসিন্দা কবির পন্ডিত, আবুল কালাম, আবদুল মান্নান, মহসিনসহ আরও কয়েকজনের ক্ষোভ, ‘শুকনো মৌসূমে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন বর্ষার অজুহাতে বাঁধ নির্মাণে বিলম্ব করছে কর্তৃপক্ষ। জোয়ারের পানিতে আমাদের ঘর-দুয়ার সব পানির নিচে ডুবে গেছে। আমরা দ্রুত মজবুত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানাই।’

 

স্থানীয় সূত্র জানায়, বৃষ্টি ও মেঘনার জোয়ারের পানিতে লক্ষ্মীপুরে সদর, রামগতি ও কমলনগরে কয়েকটি বেড়িবাঁধ নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। সদর উপজেলার চর রমনী মোহন ইউনিয়নের বুড়ির ঘাট এলাকায় নতুন করে নির্মাণ করা ওয়াপদা বেড়িবাঁধটি মেঘনা নদীর জোয়ারের পানিতে ভেঙে গেছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগের শিকার বহু মানুষ। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।

 

এলাকাবাসী জানায়, মেঘনা নদীর প্রবল জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে ২০১৪ সালের বর্ষায় বেড়িবাঁধটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরে নতুন করে বাঁধ তৈরি করা হয়। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৫৯/২ নম্বর পোল্ডারের বুড়িরঘাট ট্রাইবান প্রকল্পের আওতায় বেড়িবাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে এটি আবারও ধ্বসে পড়ে।

 

লক্ষ্মীপুরের মেঘনা তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলো জোয়ারের পানিতে ভাসছে। ৩ জুলাই রোববার দুপুরে জোয়ারের অত্যাধিক স্রোতে এলাকার গ্রামগুলোতে পানি ঢুকে পড়ে। এতে হাজারো মানুষ পানিবন্দি হন। মেঘনাতীরের বেশকিছু এলাকার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এলাকার বয়সী ব্যক্তিরা জানান, এসব এলাকার খালগুলো ভরাট হওয়ায় জোয়ারের পানি দ্রুত সরতে পারে না। মেঘনার ভাঙ্গন অব্যাহত থাকায় পলি জমে খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নদীতে জোয়ার এলে খালগুলোর ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করে পানি ঢুকে পড়ে বাড়িঘরে।

 

কমলনগর উপজেলার মেঘনা পাড়ের বাসিন্দা মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাড়ির নিকটবর্তী বেড়িবাঁধটি জোয়ারের পানিতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময় বাঁধটি ধ্বসে পড়তে পারে। এতে পাশের এলাকাগুলো জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশাংকা রয়েছে। তবে এরই মধ্যে কমলনগর উপজেলার মার্টিন, কালকিনি, ফলকন, চর লরেন্স, সাহেবেরহাটসহ রামগতি উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম জোয়ারের পানিতে ডুবে আছে।

 

 

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার খানখানাবাদ ইউনিয়নের খানখানাবাদ গ্রামের বাসিন্দা হাজী মনির আহমেদ জানান, মাত্র একমাস আগে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে এই এলাকার বাঁধ ধ্বসে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সে বাঁধ মেরামতের কাজ কেবল শুরু হয়েছিল। আকস্মিক জোয়ারের পানিতে সেখানকার নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

 

সূত্র জানায়, সমুদ্র তীরবর্তী বাঁশখালীর খানখানাবাদ, গন্ডামারা ও ছনুয়া ইউনিয়ন বছরের অধিকাংশ সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বর্ষায় এই ঝুঁকি আরও বাড়ে। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে এই এলাকার বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বাড়িঘরের সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। জমির ফসল, পুকুরের মাছ সবই ভেসে গেছে। জরুরিভিত্তিতে কিছু এলাকায় বাঁধ মেরামতের কাজ চললেও অনেক স্থান এখনও অরক্ষিত।

 

কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে সাংবাদিক জসিম মাহমুদ জানান, এবারের জোয়ারেও দ্বীপের বহু মানুষের বাড়িঘর ডুবে গেছে। মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী বাঁধটি ধ্বসে গেছে কয়েকবছর আগেই। বহু আবেদন জানানো সত্বেও বাঁধটি নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিবারের জোয়ারে ও জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপের প্রায় ৪০ হাজার মানুষের আতংকের শেষ নেই।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ জুলাই ২০১৬/রফিকুল ইসলাম মন্টু/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়