ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইলিশের খোঁজে গভীর সমুদ্রে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ১১ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৬:৪৩, ১২ অক্টোবর ২০২০
ইলিশের খোঁজে গভীর সমুদ্রে

পূর্ণিমার চাঁদ হেলে পড়েছে পশ্চিমে। ইলিশের জাল ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। এরই মধ্যে জাল টানার সময় হয়ে এলো। সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ। নোনাজলের ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ট্রলারের সবকিছু। জাল টানার জন্য জেলেরা নিজ নিজ অবস্থান নিলেন। শুরু হলো জাল টানা। কেবিনের ওপরে ট্রলারের হাল ধরে থাকা মাঝি থেকে শুরু করে সকলের চোখ জালের দিকে। কই? ইলিশের তো দেখা নেই! অনেকক্ষণ জাল টানার পর দু’একটি ইলিশের দেখা মিলল। জেলেদের মুখে ফুটল স্বস্তির হাসি।

জায়গাটি ঢালচর ইলিশ ঘাট থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে। অন্তত আড়াই ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হয়। গভীর সমুদ্র। যেখানে সাধারণত কারো যাওয়া হয় না; কেবল জেলেরাই যান জীবিকার প্রয়োজনে। এ যেন এক যুদ্ধ! এ জন্য প্রস্তুতিও কম নয়। খাবার রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় সদাই কেনা, ইঞ্জিন চালাতে তেল, ইলিশ সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত বরফ- সবকিছু নিয়ে ট্রলারে উঠতে হয়; এমনকি খাবার পানিও নিতে হয় স্থল থেকে। অথচ কেমন ইলিশ মিলবে? কখন ফেরা হবে স্থলে? আদৌ ফেরা হবে কিনা- জানা থাকে না।

ঢালচর বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে সমুদ্র মোহনার একটি দ্বীপ। দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার এই ইউনিয়নে অন্তত ৯৫ শতাংশ মানুষ মাছ ধরার ওপরে নির্ভরশীল। ইলিশের মৌসুমে এই এলাকাটি জমজমাট হয়ে ওঠে। শুধু ঢালচরের জেলে কিংবা ইলিশ ব্যবসায়ী নয়, এখানে এই সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে জেলে, ইলিশ ব্যবসায়ী, বরফ ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আসে। অন্যদের ভিড়ে আমিও সেখানে। উদ্দেশ্য খবরের খোঁজ। ইলিশের খবর, ইলিশ ধরার খবর।  ঢালচরে এর আগেও বহুবার গিয়েছি। কিন্তু এবারের যাত্রাটা একটু ভিন্ন।  

তৈয়ব আলী মাঝির ট্রলার সমুদ্রে গেছে একদিন আগে। তার ট্রলারেই যাওয়া কথা ছিল। সমস্যা নেই। যাওয়া যাবে অন্য যে কোনো ট্রলারে। খবর পেলাম নুরনবী মাঝি যাবেন সমুদ্রে, সেখানে তার সঙ্গে দেখা হবে তৈয়ব আলী মাঝির। ওই ট্রলারের জন্য বরফ নিয়ে যাবেন নুরনবী। ফলে তার ট্রলারেই উঠে পড়লাম। ট্রলার ছাড়ল। লক্ষ্য করলাম কেউ বসে নেই। জাল মেরামত করা, জাল ফেলার প্রস্তুতি- অনেক কাজ। নুরনবী মাঝি হাল ধরে আছেন শক্ত হাতে। ট্রলার চলছে সমুদ্রপানে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। দেখা মেলে তৈয়ব আলী মাঝির ট্রলারের। তখন আমরা গভীর সমুদ্রে। ট্রলার বদল হয়- উঠে পড়ি তৈয়ব আলীর ট্রলারে। তৈয়ব আলীর ট্রলার চলতে থাকে আরও গভীরে। তখন ঠিক কোথায় আমরা ভাসছি, ধারণা করা যায় না। চারদিকে শুধু জলরাশি। উত্তাল ঢেউয়ে দুলছে ট্রলার। এক মুহূর্ত কারো দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই। এমনকি ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবি তুলতে গেলেও ফোকাস ঠিক রাখা কঠিন। অনেক কষ্টে ছবি তুলতে হলো। ওদিকে রাত নিঝুম হচ্ছে। চারদিকে মিটি মিটি আলোর সারি। অসংখ্য ট্রলার ভাসছে সমুদ্রে। কাছাকাছি ট্রলারের লোকজনের সঙ্গে আলাপও হচ্ছে। কেউ আবার টর্চ লাইটের আলোর ইশারায় কথা বলছেন। তৈয়ব মাঝি ইশারা করলেন- জাল ফেলতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই তৈরি হয়ে গেল। জাল তোলার সময় যেমন একটি পদ্ধতি আছে; জাল ফেলার সময়ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। তবে জাল ফেলতে কষ্ট কম, তুলতে খাটুনি একটু বেশি। 

ইলিশ জাল ফেলার শুরুতে যেটি ফেলা হয়, তার নাম ‘আঁচলের পতাকা’। একটি লম্বা বাঁশের মাথায় একটি পতাকা লাগানো। বাঁশটির নিচের অংশে ভারি কয়েকটি ইট বাঁধা। কয়েকটি ফ্লুটও (ভাসা) বাঁধা থাকে। পতাকাটির সঙ্গে জাল আটকানো থাকে। তৈয়ব মাঝির নাম অনুসারে তার জালের কালো রঙের পতাকায় সাদা রঙে লেখা ইংরেজি ‘টি’ অক্ষর। এটা ট্রলারের সংকেত। প্রত্যেক ট্রলারেই পতাকায় এমন সংকেত আছে। সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে কয়েকজন মিলে পতাকাটি ফেলার পরেই জাল ফেলা শুরু হয়। দেলোয়ার হোসেন গোড়ার বটে, মোকতার হোসেন আগার বটে। জালের উপরে এবং নিচে যে রশি লাগানো থাকে তা স্থানীয়ভাবে ‘বট’ নামে পরিচিত। এর সঙ্গেই আবার জালের নিচের অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত গোলাকার ইট। যা জালকে নিচের দিকে টেনে রাখে। এগুলো ফেলার দায়িত্বে থাকে আরেকজন। আবার উপরের বটের সঙ্গে থাকে ফ্লুট বা ভাসা এবং এক প্রকারের পঞ্জ। এগুলোও জাল উপরের দিকে ভাসিয়ে রাখে। এগুলো সবই ঠিক একই ছন্দে ফেলতে হয়। এর দায়িত্বেও থাকেন একজন। ট্রলার চলতে থাকে, জাল ফেলাও অব্যাহত থাকে। এক সময় জাল ফেলা শেষ হয়ে যায়। জালের প্রথম অংশে যেভাবে পতাকা রাখা হয়; ঠিক শেষ অংশে জাল ভাসিয়ে রাখার জন্য যেটি দেওয়া হয়, তাকে বলে ‘ভেউরকা’। এর সঙ্গে কয়েকটি বাতি থাকে। বিশেষভাবে বানানো হয় এগুলো যাতে জাল ভাসিয়ে রাখতে পারে। রাতে জাল ফেললে এটি লাগানো হয়। দিনের বেলা প্রয়োজন হয় না। দিনে এর বদলে দেওয়া হয় আরেকটি পতাকা।

জাল ফেলা শেষ। সকলেরই খানিকটা অবসর। ইতোমধ্যে পুব আকাশের গোলাকার চাঁদখানা প্রায় মাথার ওপরে চলে এসেছে। চাঁদের আলো সমুদ্রের জলে পড়ে এক অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। নোঙ্গর করা ট্রলারখানা দুলছে ঢেউয়ের তালে। অন্য সকলের মতো তৈয়ব মাঝিরও এখন অবসর। ইঞ্জিন থামানোর পর তার এক শালাকা টানা শেষ। অন্যরাও যে যার মতো ধূমপান করছে, অথবা গল্পে মশগুল। ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বাতাসে।

সমুদ্রে ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া চারদিকে অন্য কোনো শব্দ কানে আসে না। ছলাৎ ছলাৎ অন্যরকম এক ছন্দ। এই আবহের সঙ্গে মিলিয়ে জেলেদের মধ্যে একজন গান ধরলেন মনের আনন্দে। এই সময়ে আমার ভাবনায় এলো, এ অবস্থায় জলদস্যু হানা দিলে কিংবা বড় কোনো দুর্যোগ চোখ রাঙালে কিছুই তো করার নেই। জীবিকার তাগিদে স্বজনদের ছেড়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে এসে জেলেরা একেবারেই অহসায়। এমনকি ট্রলার বিকল হয়ে গেলেও তাদের উদ্ধারে সাহায্য পাওয়া কঠিন।

রাতের খাবার শেষে জাল টানা শুরু হবে। খাবার প্রস্তুত। রান্না হয়েছে তাজা ইলিশ মাছের ঝোল। অন্যরা যখন জাল ফেলা এবং অন্যান্য কাজ করছিলেন, তখন বাবুর্চি খলিলুর রহমান রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। জাল ফেলার সময়ের সঙ্গে মিলিয়েই তার রান্না শেষ করতে হয়। অবসরে এবং খাওয়ার সময় আমরা গল্প শুনছিলাম মোকতার হোসেনের কাছ থেকে। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কয়েক বছর ছিলেন। সেখানেও কাজ ছিল মাছ ধরা। বাংলাদেশের সমুদ্রের জেলেদের সঙ্গে তূলনামূলক চিত্র তুলে তিনি বলছিলেন, বাংলাদেশ থেকে অনেক জেলে সেখানে কাজে যায়। ওই এলাকায় জেলেরা মাছ ধরে বড় স্পীডবোটে। তারা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। সেখানকার পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ। মোকতার বিদেশে মাছ ধরতে গিয়ে বিশেষ কোনো সমস্যায় পড়েননি। ৭ বছরে বেশ কিছু টাকা আনতে পেরেছেন। একখণ্ড জমিও কিনেছেন।

মাথা-হাঁটু একসঙ্গে করে ট্রলারের কেবিনে ঢুকতে হয়। সকলে গোল হয়ে বসে খাই। মাঝে মাঝে ঢেউয়ের মাত্রা বেড়ে গেলে কেবিনের উপরের পাটাতন মাথায় আঘাত করে। ওদিকে গল্প শুনতে শুনতে জাল টানার সময় হয়ে যায়। সবাই এবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।

সমুদ্রের আলো ঝলমল রাত। মাথার ওপরে আকাশে চাঁদ আর ট্রলারে সৌরবাতির আলো। আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি পৌঁছে গেছে গভীর সমুদ্র পর্যন্ত। অথচ সৌরবাতি আসার আগে এই স্থানটি কুপি বাতির দখলে ছিল। কর্মক্ষেত্রে সৌর বাতির আলো পড়েছে বটে; জেলেদের জীবনে কী আলো পড়েছে? এ প্রশ্নের জবাব নেই।

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়