ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

সাতক্ষীরায় কোটি টাকার মধু আহরণ

এম শাহীন গোলদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাতক্ষীরায় কোটি টাকার মধু আহরণ

মৌচাষি আফজাল

এম শাহীন গোলদার
সাতক্ষীরা, ২৩ ফেব্রুয়ারি : আধুনিক পদ্ধতিতে ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামারে আহরণ হচ্ছে কোটি কোটি টাকার মধু।

দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও উৎপাদিত এ মধু রপ্তানি করা যেতে পারে বলে আশাবাদী এ অঞ্চলের মৌচাষিরা।

অন্যদিকে মধু অধিক লাভজনক হওয়ায় জেলায় ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার ব্রজাবক্স গ্রামের সফল মৌচাষি ও বাংলাদেশ মৌচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবাদুল্লাহ আফজাল জানান, প্রায় ১৫-১৬ বছর যাবৎ তিনি আধুনিক পদ্ধতিতে ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামারে মৌচাষ করছেন। প্রতি মৌসুমে ২৫ থেকে ৩০ মেট্রিক টন মধু উৎপাদন করেন তিনি। যার আনুমানিক মূল্য ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকা। এসব মধু দেশের বিভিন্ন আয়ুর্বেদ ও হারবাল ওষুধ কোম্পানি কিনে নেয়। এর মধ্যে এপি, মডার্ন হারবাল, হামদর্দ, প্রশিকা ও ফেইম মধু বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। তবে এদের চাহিদা আরো অনেক। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করা যায় না বলে জানান তিনি।

বর্তমানে তার ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামারে ৫০০ থেকে ৬০০ মৌ-কলোনি বা মৌ-পালন বক্স রয়েছে।

তিনি জানান, একেকটি বক্সে একটি করে রানী মাছি, ১০০ করে পুরুষ মাছি ও তার সঙ্গে এক লাখ করে শ্রমিক মাছি থাকে। এসব মাছি বিভিন্ন ফুল থেকে মধু আহরণ করার পর তা ওই বক্সে সঞ্চয় করে। তবে রানী মাছি অবশ্যই ভালো জাতের হওয়া লাগবে।

তিনি আরো জানান, দুই হাজার ৫০০ মেট্রিক টন মধুর সিংহ ভাগই উৎপাদন করে সাতক্ষীরার ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামারিরা। বর্তমানে তার মৌ-খামারের সংখ্যা ছয়টি। পরাগায়নের ক্ষেত্রে মৌমাছি প্রধান সহায়ক। সঠিক পরাগায়ন না হলে কাঙ্ক্ষিত ফলন হবে না। দেখা দেবে খাদ্যঘাটতি। উন্নত দেশগুলোতে মধু চাষের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশে মৌচাষিদের সংগঠিত করে মৌচাষি কল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছি।

২০১১ সালের ১২ জানুয়ারি আমরা সমিতির নিবন্ধন করি। মৌচাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, ‘মধু বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের জন্য ইতিমধ্যে ঢাকার এপি মধু কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি আরও অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্য।’

মৌমাছির জাত ও মধু উৎপাদনের সময় প্রসঙ্গে তিনি জানান, আমরা দুই ধরনের মৌচাষ করে থাকি। এপিস সেরেনা মৌচাষ দেশীয় মৌমাছি দ্বারা পরিচালিত এবং এ চাষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ৫-১০টি মৌ-কলোনি নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশে চার প্রকার রানী মাছির উপস্থিতি রয়েছে। এগুলো হলো- এপিস ডরসেটা, এপিস সেরেনা, এপিস ফোরিয়া ও এপিস মেলিফেরা। তবে মধু আহরণের ক্ষেত্রে এপিস মেলিফেরা এ এলাকার জন্য খুবই উপযোগী বলে তিনি মনে করেন। তার ওই ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামার দেশের বিভিন্ন এলাকাতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার খামারে সরিষা ফুলের মধু, কালো জিরার মধু, ধনিয়ার মধু, রাইসরিষা ফুলের মধু, লিচু ফুলের মধু এবং সুন্দরবনের খলিশা, গরান, কেওড়া ও বাইন গাছের ফুলের মধু উৎপাদিত হয়।

মৌচাষি আফজাল আরো জানান, ১৯৯৪ সালে এইচএসসি পাস করার পর তিনি মৌচাষের ওপর বিসিক ও এসএমই প্রশিক্ষণ নেন এবং মাত্র ২০টি মৌ-পালন বক্স নিয়ে ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামার শুরু করেন। এখন তার প্রতি মৌসুমে উৎপাদন ও শ্রমিক খরচ তুলেও ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা লাভ হয় বলে জানান তিনি।

সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা গ্রামের আরেক ভ্রাম্যমাণ মৌচাষি আইয়ুব আলী জানান, ১২-১৩ বছর ধরে আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ খামারে মৌচাষ করে আসছেন। নিজ জেলা ছাড়াও তার ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামার দেশের উত্তরবঙ্গ এলাকাতে নিয়ে যান মধু আহরণের জন্য। প্রতি মৌসুমে ১৫-১৮ মেট্রিক টন মধু উৎপাদন করেন।

তিনি বলেন, সরকারের সহায়তা পেলে সাতক্ষীরার মধু বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।

মৌচাষি কল্যাণ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, দেশে মধুর চাহিদা রয়েছে বছরে ছয় হাজার মেট্রিক টন। আর এই চাহিদার বিপরীতে উৎপাদিত হয় তিন হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে সুন্দরবন থেকে আসে ৫০০ মেট্রিক টন এবং আধুনিক পদ্ধতিতে ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামারের মাধ্যমে উৎপাদন হয় দুই হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।

কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্বপন কুমার খাঁ জানান, আফজাল আজ পরিপূর্ণ এক সফল ও স্বাবলম্বী মৌচাষি। তিনি নিজে মৌচাষ করে ভাগ্য বদলিয়েছেন। অপরকেও ভাগ্য বদলেও সহায়তা করে যাচ্ছেন। ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষ অত্যন্ত লাভজনক একটি শিল্প। মৌচাষি সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা বিসিকের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপব্যবস্থাপক আব্দুল ওয়াদুদ জানান, সাতক্ষীরা জেলাকে মডেল হিসেবে নেওয়া হয়েছে। জেলার সাতটি উপজেলায় কমপক্ষে ১৭০টি ভ্রাম্যমাণ মৌ-খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারিকে আধুনিক পদ্ধতিতে মধু উৎপাদনের ওপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। ভ্রাম্যমাণ মৌচাষ অত্যন্ত লাভজনক একটি শিল্প।

তিনি জানান, দেশের মোট মধু উৎপাদনের সিংহ ভাগই জোগান দেন সাতক্ষীরার মৌয়াল বা মৌচাষিরা। ইতিমধ্যে সরকার নয় কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা জেলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।



রাইজিংবিডি/সোহাগ / আবু মো.


রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়