ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পাকিস্তানের যে বাজারের ছেলেরা বলিউড নিয়ন্ত্রণ করতো

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ৮ জুলাই ২০২১   আপডেট: ২০:৫৪, ৮ জুলাই ২০২১
পাকিস্তানের যে বাজারের ছেলেরা বলিউড নিয়ন্ত্রণ করতো

বাজারের গলিতে এখনো শোভা পায় দিলীপ কুমারের ছবি

প্রাচ্য ও পশ্চিমের সঙ্গে সেতুবন্ধন সৃষ্টিকারী সিল্করুটের উপর দাঁড়িয়ে পেশোয়ার শহর। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তঘেঁষা। বলা যায় বিশাল ভারতবর্ষের সিংহ দুয়ার। তাই প্রাচীনকাল থেকে পেশোয়ার ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এর দখল নিতে আফগানদের সঙ্গে মোগল ও শিখদের বহুবার যুদ্ধ হয়েছে। ব্রিটিশরাও লড়েছে। এখানকার অধিবাসীরা জাতিগতভাবে পাঠান। তাদের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক মিল আফগানদের সঙ্গে। কিন্তু কয়েকশ বছর ধরে তারা ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে। এই টানাপড়েন যুগ যুগ ধরে এখানকার অশান্তির মূল কারণ।

এই পেশোয়ারের বিখ্যাত একটি বাজারের নাম কিসস্যাকাহানি বাজার। এর বয়স দুই হাজার বছরেরও বেশি। এ বাজার বিখ্যাত এখানকার মানুষের গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতার জন্য। খাইবার-পাখতুন গিরিপথের মুখে হওয়ায় এখানে আসে আফগান মোগল তাজিক চৈনিক ভারতীয় গ্রিক-এশিয়া ইউরোপের প্রায় সব জাতিগোষ্ঠী। হয় রমরমা বিকিকিনি। এই বিকিকিনির সঙ্গে হয় ভাববিনিময়। বসে গল্পের আসর। গল্পের লোভে পথচলতি মানুষ দাঁড়ায়। চতুর বণিকরা এ সুযোগে তাদের পণ্য এগিয়ে দেয়। বাড়তি কিছু বিক্রি হয়। সঙ্গে ছোট ছোট বাটিতে দেয়া হয় পেশোয়ারের বিখ্যাত সবুজ চা ‘কেহওয়া’। পেশোয়ারের এক সময়কার ইংরেজ কমিশনার স্যার এডওয়ার্ড কিসস্যাকাহানি বাজারকে মধ্য এশিয়ার পিকাডিলির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

১৯০০ সালে কিসস্যাকাহানি বাজার

অনুপম চোপড়ার লেখায় কিসস্যাকাহানি বাজারের দারুণ এক বর্ণনা মেলে: 
‘প্রাচীন তৈজষপত্র, শাল, পেশোয়ারী জুতো, শুকনো ফল, ডাল থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছুই এ বাজারে পাওয়া যায়। বাজারের ভারী বাতাসে মানুষের কোলাহল, মাংসের গ্রিল, তাজা রুটি আর তাজা ফলের রসের গন্ধ মিশে আছে। দোকানগুলোর উপর আছে মানুষের বাসস্থান। এই দোকানগুলোর পাশ দিয়ে সরু হয়ে ঢুকে যাওয়া অসংখ্য গলিতে আছে বিভিন্ন মহল্লা। ঘনবসতিপূর্ণ এ মহল্লার গলিগুলো এতই সরু যে কোথাও কোথাও দু’জন মানুষ পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারে না।’

এ বাজারের ঐতিহ্য গান ও কবি লড়াই। এ সাংস্কৃতিক পরম্পরা চলে আসছে কয়েকশ বছর ধরে। এর সূত্র ধরে এই বাজারের ছেলেরা একসময় বলিউড নিয়ন্ত্রণ করত। শুরুটা মূলত পৃত্থিরাজ কাপুরের হাত ধরে। ১৯২৮ সালে তিনি মুম্বাইতে গিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পে ‘কাপুর সাম্রাজ্যে’র সুচনা। তারপর একে একে রাজ কাপুর, শাম্মী কাপুর, শশী কাপুর, রণধীর কাপুর, ঋষি কাপুর, রাজীব কাপুর, করণ কাপুর, কুনাল কাপুর, সানজানা কাপুর, কারিশমা কাপুর, কারিনা কাপুর, রণবীর কাপুরের আবির্ভাব। এই কাপুর পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে পরবর্তী কালে প্রতিষ্ঠা পায় বচ্চন পরিবার, নাথ পরিবার, সুরিন্দর পরিবার, পতৌদি পরিবার।

পৃত্থিরাজ কাপুরের পরপর ত্রিশের দশকে ফলবিক্রেতা পিতার হাত ধরে মুম্বাই চলে আসেন ইউসুফ খান। পৃত্থিরাজ কাপুরের ছেলে রাজ কাপুর ছিল তার শৈশবের বন্ধু। তার সহযোগিতায় তিনি বলিউডে সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৪৪ সালে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘জোয়ার ভাটা’ মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য ছদ্মনাম ধারণ করেন ‘দিলীপ কুমার’। ১৯৪৯ সালে ‘আন্দাজ’ সিনেমা দিয়ে তিনি সাধারণ দর্শকের চোখে পড়েন। আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয় নি। সেই সিনেমায় সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছিলেন বাল্যবন্ধু রাজ কাপুরকে।

কিসস্যাকাহানি বাজারের বর্তমান অবস্থা

দিলীপ কুমারের পাশের গলি শাহওয়ালি কাতাল মহল্লা থেকে আরেক যুবক মুম্বাইতে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য। তার নাম মীর তাজ। তিনি সাফল্যের মুখ না দেখলেও তার পুত্র পরবর্তী কালে বলিউডের সুপারস্টার হন। তার নাম শাহরুখ খান।

১৯৩০ সালে এই কিসস্যাকাহানি বাজার সারা ভারতের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। ২৩ এপ্রিল গান্ধী আদর্শে বিশ্বাসী খুদাই খিদমাতগিরের নেতা আব্দুল গাফফার খান গ্রেপ্তার হলে জনতা সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ পুলিশ উন্মত্ত জনতার উপর গুলি ছুঁড়লে ৪০০ মানুষ মারা যায়।

এক সময় এ বাজার ছিল ভারতীয় কমিউনিস্টদের শক্ত ঘাঁটি। প্রগতিশীল রাজনীতি চর্চার জন্য এর খ্যাতি ছিল। এ অঞ্চলের মানুষ নিরঙ্কুশভাবে মুসলমান হওয়ার পরও ১৯৩৭ ও ১৯৪৬-এর নির্বাচনে কংগ্রেসকে ভোট দেয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীর সর্দারদের হাতে টাকা তুলে দিয়ে হিন্দু-মুসলমান-শিখ দাঙ্গা লাগিয়ে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়। সকল অমুসলমানকে জোরপূর্বক দেশত্যাগ করানো হয়।

কৃষ্টি সংস্কৃতির শহর কিসস্যাকাহানি বাজার এখন জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর দখলে। আফগানিস্তান সীমান্ত খুব কাছে হওয়ায় পাকিস্তান সরকার কোনোভাবে এর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ৮০-র দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র আফগান সীমান্ত থেকে মাত্র ১৫০ কিমি দূরত্বের পেশোয়ার শহরকে রসদ সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। ২০০১ সালে তালেবানবিরোধী অভিযানেও পেশোয়ারকে ব্যবহার করা হয়। ২০০৭ সালে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে সারা পাকিস্তানে জঙ্গিরা সহিংস হয়ে ওঠে। পেশোয়ার তাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হয়।

কিস্যাকাহানি বাজারে দিলীপ কুমারের বাড়ি

২০১০ ও ১৩ সালে এখানে বোমা হামলা হয়। এই দুই হামলায় ২৫ ও ৪১ জন নিহত হয়। ২০১৩-এর বোমা হামলা সারা দুনিয়ার মিডিয়ার আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বোমা হামলাকারী ২২০ কেজি বিস্ফোরক বহন করেছিলেন। একসময় কিসস্যাকাহানি বাজার পাকিস্তানের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ২০০৭ সালের পর এখানে পর্যটক আসা বন্ধ হয়। লাগাতার বোমা হামলার মুখে থিয়েটার, সিনেমা হল, গান বাজার, গল্পের আসর সব বন্ধ। 

এতো কিছুর মাঝে ১৯৮৮ সালে দিলীপ কুমার তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত শহর দেখতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল কাপুর পরিবারের সদস্য। দিলীপ কুমারকে পাকিস্তান সরকার নিশান-ই-ইমতিয়াজ নামের সর্বোচ্চ বেসমারিক পদকে ভূষিত করেছে।

সূত্র: কিং অব বলিউড শাহরুখ খান এন্ড দ্যা সিডাকটিভ ওয়ার্ল্ড অব ইন্ডিয়ান সিনেমা, অনুপমা চোপড়া, ভাষান্তর: কাউসার সারোয়ার, হাওলাদার প্রকাশনী, উইকিপেডিয়া, ইন্ডিয়ান টাইমস ও অন্যান্য পত্রপত্রিকা
 

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়