ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

হে প্রেমিক! হে বিপ্লবী! নজরুলের কাছে খোলা চিঠি

শেখ কানিজ ফাতেমা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৩, ২৭ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ২০:৩৬, ২৭ আগস্ট ২০২১
হে প্রেমিক! হে বিপ্লবী! নজরুলের কাছে খোলা চিঠি

প্রিয় নজরুল, 
তোমাকে আর কী বলে সম্বোধন করব? তুমি আমার প্রাণে, আত্মায়, আমার অস্তিত্বে এমনভাবে মিশে আছ যে, গভীর ভালোবেসে ছাড়া অন্য কোনোভাবে আমি তোমায় ডাকতে পারি না। 

তোমাকে প্রথম ভালবাসা আমার শৈশবে। যখন আমার ঘুম হতো না আমার মা যিনি তোমার অন্ধ ভক্ত ছিলেন- তোমার গান শুনিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াতেন। কানে এখনো বাজে মায়ের গাওয়া গান— 

‘আমার ঘরে মলীন দ্বীপালোকে জল দেখেছি যেন তোমারও চোখে’
অথবা 
‘আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়’

ঘুম থেকে উঠেও দেখতাম মা গুনগুন করে তোমার গানই গাইছেন আর রান্না করছেন। তোমার গান, কবিতা, চিঠিগুলো আমার এত পরিচিত যে, কখনও মনে হয়নি তুমি বাইরের কেউ। 

মায়ের সব বই এক এক করে পড়ে ফেললাম। আমার জীবনে আমি প্রথম আবৃত্তিও করেছি তোমার লেখা কবিতা ‘কামাল পাশা’। তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। নানু শিখিয়েছিলেন। আমি স্টেজে উঠে শুরু করলাম—

‘ওই ছুটেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই’

তুমিই আমাকে চেনালে কামাল পাশা, বেদুঈন, চেঙ্গিস, শাত-ইল-আরব, আনোয়ার। তোমার গানে প্রথম নাচলাম। তখন ক্লাস সিক্সে। 

‘আমি যার নূপুরের ছন্দ, বেণুকার সুর কে সেই সুন্দর? কে?’

তখন থেকেই তুমি এমনভাবে মিশে গিয়েছিলে আমার মাঝে। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। হযরত শাহআলী গার্লস স্কুলে। প্রথম আন্দোলন করলাম, প্রথম স্লোগান দিলাম সেটাও তোমার সেই বিখ্যাত কবিতা—

‘লাথি মার ভাঙরে তালা
যতসব বন্দিশালা 
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা।’

স্কুলের তালা ভেঙে রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমার প্রথম বিপ্লব তুমি। আবার আমার প্রথম প্রেমও তুমি। কত রাত আমি তোমার কবিতা পড়ে অঝোরে কেঁদেছি। দোলনচাঁপা, অগ্নিবীণা! 

যতবার ‘চৈতি হাওয়া’ পড়ি আমার বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে। তোমার চিঠিগুলো পড়লে আমার মনে হয় আহা! আমিই কি সেই নার্গিস? অথবা আমিই কি ফজিলাতুন্নেছা? তুমি যেন মিশে আছ আমার প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্তের নীরব বিরহ বেদনায়। 

আমার চরম অবসেশন, ডিপ্রেশন আর একা একা দিনগুলোতে তুমি আমায় ছেড়ে যাওনি কখনো। কত যতনে তোমার প্রতিটি পংক্তি আমাকে আগলে রেখেছে। আমি যাকে ভালোবেসেছি তুমিও তাকেই ভালোবেসেছ আমারই মতো। আমি যখন কেঁদেছি তুমিও যেন কেঁদেছ আমারই সাথে। 

রাতের পর রাত কথা বলতে না পেরে যে জ্বালা আমার বুকে ভিসুভিয়াস হয়ে জ্বলেছে সে জ্বালা যেন তুমিও নিয়েছ অবলীলায়। তোমাকে ভালোবেসে আমিও তোমারই মতো ভালোবাসার ক্ষেত্রে নাছোড়বান্দা। তুমি আমার এই হাতে যেমন ‘অগ্নিবীণা’ তুলে দিয়েছ, তেমন এই বুকে ফুটিয়েছ ‘দোলনচাঁপা’। 

তোমার প্রতিটি কবিতায় আমি নিজেকে খুঁজে পাই। তোমার মতো এত বীরদর্পে কেউ যেমন বিপ্লব করতে পারে না, আমার চোখে তেমন এমন যতন করে হয়তো দুঃখও নিতে পারে না কেউ। তোমাকে ভালোবেসে আমিও তেমন যতনে দুঃখ নিতে শিখেছি। এইখানেই তুমি-আমি মিলেমিশে একাকার। 

নিজেকে আমি কখনই তোমার ভক্ত বা শিষ্য বলি না। আমি খুব গর্ব করে বলি- আমি তোমার প্রেমিকা। মোতাহার হোসেনকে লেখা তোমার চিঠিতে তুমি বলেছিলে—

‘শ্রদ্ধা, এ নিয়ে আমি কি করব?’

তুমি চেয়েছিলে ভালোবাসা। আমি সেই ভালোবাসা নিয়েই বারবার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমাকে স্মরণ করি হে অভিমানী। অভিমানটাও যেন আমি পেয়েছি তোমার কাছ থেকেই। তাই নীরবে আমি আমার সব অভিমান চোখের জলে ঝরিয়ে যাই। 

হে প্রেমিক! হে বিপ্লবী! তুমি আছ আমার এই বিক্ষিপ্ত, তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের অব্যক্ত কথা হয়ে। যা আমি বলতে পারি না, সেটা তুমি বলে গেছ কত অবলীলায়। আমার জীবনে তোমার প্রভাব কোনো দাঁড়িপাল্লায় মাপা যাবে না। 

আমার জীবনে তুমি অমর, অক্ষয়। তুমি আমার সর্বকালের প্রেমিক- যে আমায় কখনো ছেড়ে যায়নি। অশ্রু জলে ভাসায়নি। তুমি আমার সর্বকালের সহযোদ্ধা- যে আমার সাথে প্রতিনিয়ত বাজিয়ে যায় ‘অগ্নিবীণা’। ভালোবাসাই দিলাম তোমায়, এক বুক ভালোবাসা।

ইতি-
তোমার সর্বকালের প্রেমিকা

লেখক : আইনজীবী, লেখক ও নাট্যকর্মী।

ঢাকা/সনি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়