ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

১৭ রমজান: সত্যনিষ্ঠা ও আনুগত্য প্রদর্শনের এক ঐতিহাসিক দিন

মাওলানা শেখ ফজলুল করীম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩০, ৯ এপ্রিল ২০২৩   আপডেট: ১৫:৩৪, ৯ এপ্রিল ২০২৩
১৭ রমজান: সত্যনিষ্ঠা ও আনুগত্য প্রদর্শনের এক ঐতিহাসিক দিন

وَ لَقَدۡ نَصَرَکُمُ اللّٰهُ بِبَدۡرٍ وَّ اَنۡتُمۡ اَذِلَّۃٌ ۚ فَاتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۱۲۳

আর অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে বদরে সাহায্য করেছেন অথচ তোমরা ছিলে হীনবল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আশা করা যায়, তোমরা শোকরগুজার হবে। (সুরা আল-ইমরান:১২৩)

আরো পড়ুন:

হিজরতের পরে দ্বিতীয় বছরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নিজেকে এবং বিগত ১৩ বছরে নির্মম নির্যাতনের শিকার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে গুছিয়ে উঠছিলেন তখনই বদরের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। মাত্র ৩১৩ জন সাহাবা ও যৎসামান্য অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের সেরা সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করেন এই ১৭ রমজানে।

বাহ্যিকভাবে উভয় দলের শক্তিতে এতোটা পার্থক্য ছিলো যে, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি দুই হাত ওপরের দিকে তুলে কেঁদে আকুল হয়ে দোয়া করছিলেন,‘হে দয়াময় আল্লাহ! আগামীকালের নীতিনির্ধারণী যুদ্ধে তোমার সাহায্য আমাদের অতি প্রয়োজন। এই যুদ্ধে আমরা তোমার সাহায্য ছাড়া বিজয় লাভ করতে পারব না। আর আমরা যদি পরাজিত হই তাহলে তোমাকে সিজদা করার কিংবা তোমার নাম ধরে ডাকার লোক এই পৃথিবীতে আর নাও থাকতে পারে। অতঃপর তুমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর কী করবে। কারণ, তুমিই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মালিক। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। আমরা আমাদের জীবন তোমার পথে উৎসর্গ করলাম। বিনিময়ে তোমার দ্বীনকে আমরা তোমার জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তুমি আমাদেরকে বিজয় দান করো। আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাই।’ (যুরকানি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১৯ ও ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭)

আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় রাসুলের দোয়া কবুল করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয় লাভ করেছিলেন। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম  আরবের কিছু মানুষের বিশ্বাসের স্তর থেকে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীতে মানবতার নতুন জয়গান তৈরি হয়।

এই যুদ্ধের সামাজিক ও রাজনৈতিক আবেদন ছিল বিশাল। আরবের সেরা সেনাবাহিনী ও আরবের সেরা সমরনায়করা এই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি বন্দি হয়। এর প্রভাব পড়েছিল আরবজুড়ে। ইসলাম যে বিচ্ছিন্ন কোনো মতবাদ নয় বরং একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে তৈরি হচ্ছে তা আরবদের অনুধাবনে আসে। এই যুদ্ধের পরে যুদ্ধবন্দী বিনিময় নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কৌশল নিয়েছিলেন তাতে যে দয়া ও মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তারও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়েছিলো আরবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই যুদ্ধের পরে ইসলাম আরবে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

এই যুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিক্ষা হলো, সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে যেকোন মূল্যে অবস্থান নিতে হবে। তাতে বাহ্যিকভাবে নিজেদের অবস্থান দুর্বল মনে হলেও আল্লাহ তায়ালা সহায়তা করবেন। বদরের ময়দানে দুর্বল মুসলমানদের সহায়তায় সরাসরি ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়েছিলো।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সেই সময়ের কথা স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের প্রতি ওহি প্রেরণ করেন যে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সুতরাং তোমরা ঈমানদারদের অবিচল রাখ। যারা বেঈমান, শিগগিরই আমি তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই তাদের গর্দানের ওপর আঘাত হানো এবং তাদের জোড়ায় জোড়ায় হত্যা করো। এই নির্দেশ এ জন্য যে তারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরোধিতা করে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। তাই (বর্তমানে) তোমরা এ শাস্তি আস্বাদন করে নাও আর জেনে রাখো, কাফিরদের জন্য রয়েছে দোজখের আজাব।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ১২-১৪)

আজও যদি কেউ সত্য, ন্যায় ও মাজলুমের পক্ষে দৃঢ়-অবিচল হয়ে লড়াই করে তাহলে আল্লাহ তাদেরকেও একইভাবে সহয়তা করবেন।

বদরের যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরামের আনুগত্য ছিলো চুড়ান্ত। যুদ্ধে আলোচনা যখন চলছে তখন সাহাবায়ে কেরাম বলেছিলেন,‘আমরা আপনার ডানে যুদ্ধ করব, আপনার বামে যুদ্ধ করব, আপনার সামনে যুদ্ধ করব, আপনার পিছনে যুদ্ধ করব এবং হে আল্লাহর রসুল! যে দুশমন আপনার ক্ষতি সাধন করতে এসেছে তারা আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা আমাদের লাশের ওপর দিয়ে যাবে। হে আল্লাহর রাসুল! যুদ্ধ তো একটা মামুলি ব্যাপার। এখান থেকে কিছু দূরেই সমুদ্র, আপনি যদি হুকুম দেন যে, তোমরা তোমাদের ঘোড়া নিয়ে সেই সমুদ্রে ঝাঁপ দাও, তাহলে আমরা তৎক্ষণাৎ ঘোড়াসহ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ব।(ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২)।

বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা এই যুদ্ধে অংশ নেয়া সাহাবায়ে কেরামের অতিতে ও ভবিষ্যতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন 'হে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার সাহাবারা, তোমাদের জন্য জান্নাত অবধারিত।' অন্য এক হাদিস থেকে জানা যায়, বদরী সাহাবাদের জন্য জাহান্নাম হারাম। (মুসলিম : ২৪৯৫) আরো এক হাদিস রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের আগে পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। (মুস্তাদরাক : ৪/৮৭)

এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিময় ১৭ রমজান আমরা যারা পেয়েছি তাদের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ। সত্যের পক্ষে থাকার অটল-অবিচল প্রতিজ্ঞা করা উচিৎ এবং আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ করার মানসিকতা থাকা উচিৎ। তাহলে আমরাও আহলে বদরের মতো সন্মানিত হতে পারবো বলে আশা করা যায়।

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়