বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস
পাখি মারা জাল
হাসনাত মোবারক || রাইজিংবিডি.কম

ছোট পানচিল, ছবি : তুহিন ওয়াদুদ
প্রায় ৩০ বছর আগের ঘটনা। ওই সময় মাঠের বেশিরভাগ জমিতে গম চাষ হতো। বাচ্চাদের কাছে আনন্দ জাগানিয়া একটি কাজ ছিল গমের খেতের পাখি তাড়ানো। কাক, কবুতর, সারসসহ অন্যান্য পক্ষি লকলকে গজিয়ে ওঠা চারা উপড়িয়ে ফেলতো। দুই তিন সপ্তাহ কিশোর-কিশোরীরা জমিগুলো পাহারা দিতো। কাজটি খুব আনন্দের সঙ্গে করতো সবাই। দলবেঁধে ভোরে সবাই উপস্থিত হতো ফসলি জমিতে। মজার মধ্যে একটি ছিল চড়ুইভাতি। মাঠের মধ্যে কয়েকজন মিলে চুলা বানিয়ে ফেলতো। বাড়ি থেকে চাল, খড়ি, পাতিল, মশলাপাতি নিয়ে যেত। বিল থেকে মাছ ধরে এনে কাটাকুটি করে রান্না হতো তরকারি। রান্না শেষে সবাই একজোট হয়ে মজা করে খাওয়া। কী যে এক আনন্দ যজ্ঞ!
তবে এ আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হতো না। লাঙলের কুটি ধরা শিখলে গমের খেতে পাখি তাড়ানোর, ‘হ্যাঁলো/বেলা গেলো/পাখি তাড়ালো’ বোল ভুলে তাকে গরুর হাল নিয়ে নামতে হতো মাঠে। শুরু হতো জীবন যুদ্ধ। আমাদের প্রজন্ম গরুর হালের লাঙল ধরা শেখার আগেই জমি চাষের জন্য চলে এলো কলের লাঙল (ট্রাক্টর)। সে গল্প আপাতত উহ্য রাখি।
ফিরি পাখি বিষয়ে। সে বছর উজারা খাপালে (বিল) গম বোনা হয়েছে। যেহেতু বিলের পানি নেমে যেত দেরিতে। সঙ্গত কারণেই উঁচু জমির ফসল তত সময়ে বড় হয়ে গেছে। তাই গ্রামের মানুষের নজর তখন গিয়ে পড়েছে উজাইরা খাপালের দিকে। শুধু মনুষ্যকূলই নয় পাখিকূলেরও প্রকোপও পড়লো খাপালের বোনা রবিশস্যের ওপর। তখন এই বিলের প্রায় সব জমির মালিকানা এক পরিবারের ছিল। অন্যান্য বিলের মালিকানাও ছিল অবস্থাপন্নদের। বিলের মধ্যে ডোবা থাকাটা সে সময়ে ছিল আভিজাত্যের বিষয়। ওই উজারা খাপালের মধ্যে মধ্যে দুটি ডোবা ছিল। সারা বছরই সেখানে পানি থাকতো। বিলের মধ্যে নানান জাতের পাখির দেখা মিলতো। বিশেষ করে শীতের সময়। ওই বিলের জমিতে বছরে একবার ফসল হতো। কিন্তু কীভাবে যে ওই বিলের পানি শুকিয়ে গেল। আমার সে ঘটনা জানা নেই।
ওই বিলের মালিকদের মধ্যে একজন হলো আমার শৈশবের বন্ধু রাজ্জাক। ও আমার চেয়ে বয়সে কয় বছরের বড়। জটিল কোনো কাজের সমাধানের জন্য সে ছিল ওস্তাদ। রাজ্জাক গল্প বলতো আমরা শুনতাম। ওর নানা, খালাদের বাড়ি ছিল দূরের গ্রামে। ট্রেনে যাতায়াত করতো। নানান কিছু দেখে এসে নতুন নতুন গল্প বলতো। আমরা কৌতূহলী হয়ে সেসব শুনতাম। বিস্ময় বনে যেতাম। মনে মনে ভাবতাম, কবে যাব দূর রাজ্যে। নানান সব কারণে রাজ্জাক ছিল আমার পছন্দের একজন। যার ওপর মানুষ নির্ভর করে তার সব কথাই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে।
ওদের জমির গম খেয়ে ফেলছে বিলের ডোবায় থাকা ঘরকন্যাদের পাতিহাঁস। হাঁসসহ অন্যান্য পাখির অত্যাচারের জমির ফসল পাহারারত ছেলেপুলেগুলোও পাগাল পাড়া।
তখন জমির চারপাশে ফাঁস জাল দিয়ে বেড়া দেওয়া হলো। তখনকার দিনে দুই, আড়াই, পৌণে তিন, চার, পাচ ইঞ্চি পরিধির ফাঁস জালের প্রচলন বেশি ছিল। রুই, কাতলা, বোয়াল ধরা পড়তো সেসব জালে। কোনো কোনো বছর তো ইলিশ দেখা দিতো বিল চলনের জলে। এখনকার দিনে এ কথাকে কেউ কেউ রূপকথা ভেবে বসতে পারেন। চলনবিলে বর্ষা মৌসুমে ইলিশও ধরা পড়তো। ঘরে ঘরে সবাই ফাঁস জাল ছিল। আর কই মারা জালের কথা কী আর বলব। কোনো বাড়িতে নৌকা এবং কই ধরা জাল নেই, সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। যে কারণে প্রত্যেক ঘরে ঘরে ফাঁস জাল, কই মারা জাল থাকতো। কিন্তু এই জাল যে সেবার হাঁস ঠেকাতে বেড়া হিসেবে ব্যবহার করেছিল জমির মালিকরা। এরকম বেড়া প্রায় মানুষই করে থাকে জমির আইলে।
তিন দশক পেরিয়ে গেছে। ঘটনাটি আমার মনে এখনও রয়েছে। দাগ কেটেই আছে। হেমন্তের নরম রোদ কেবল চড়চড় করে উঠছে পূর্ব দিগন্তে। উজারা খাপালটির অবস্থান গ্রাম থেকে পশ্চিমে। একদল ছেলে মেয়েরা দৌড়ে আসছে বাড়ির দিকে। হাতে তাদের ফাঁস জালের গোছা। বিল থেকে মাছ ধরে জাল নিয়ে উঠে আসা এটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ওই দলের মধ্যে আমার সেই শৈশবের বন্ধুটি থাকায় আমিও এগিয়ে গেলাম। পৌঁছে দেখি, জালে মাছ নয়, ধরা পড়েছে রঙিন রঙনি পাখি। কত যে পাখি, সাদা জালের মধ্যে পেঁচিয়ে আছে। ওই প্রথম দৃষ্টিনন্দন পাখি দেখা আমার। যে পাখিগুলো আমি এর আগে কখনও এত কাছ থেকে দেখিনি। বিস্ময় নিয়ে বন্ধুটির কাছে পাখিগুলোর নাম জানতে চাই, সে হরহর করে বলে দিচ্ছে। সত্যি কি সে এই পাখিগুলো সে চিনতো! না। ঘটনার অনেক পরে আমি ওদের পাখিমারার ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। সে ঠিকঠাক স্মরণ করতে পারেনি। কিন্তু আমার নরম মনে এখনও সেই দৃশ্য প্রোথিত আছে। আজ বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। খুব করে মনে পড়ছে শৈশবে দেখা ওই পাখিগুলোর কথা। ওরা বুঝি পরিযায়ী ছিল। মালিক তো বেড়া দিয়েছিল হাঁস ঠেকানোর জন্য। হাঁসসহ অন্যান্য কোনো চেনা পরিচিতি পাখিই তো ধরে পড়ে নি সে জালে। ধরা পড়লো সুদূর থেকে আসা পাখির দল।
পাখির ঝাঁক যে স্থানে জালে আটকা পড়েছিল, সেই বিলগুলোর গভীরতা আর তেমন আর নেই। যে কারণে ওই জাতের পাখিগুলোর ফিরে আসারও কোনো যুক্তি নেই। আমরা তো ওদের আশ্রয় রেখে দিতে পারিনি। এ বিল বাওড় ভরাটের পিছে নানাবিধ কারণ রয়েছে। ১৯১৩ সালে রিপোর্ট থেকে জানা যায়, চলনবিলে বারো থেকে পনেরো বর্গমাইল জায়গাতে সারা বছর পানি থাকে। আর বৈশাখ মাসে জলের গভীরতা গড়ে ৯ থেকে ১৮ ইঞ্চি। আরও জানা যায়, বিলের গর্ভে প্রতিবছর অর্ধ ইঞ্চি করে পলি পড়ে। এর মধ্যে চলে গেছে কত কত বৎসর। বিল ভরাট করে গড়ে উঠছে জনবসতি। তাই এ অঞ্চলে কমে গেছে পরিযায়ী পাখির আনাগোনা।