ঢাকা     বুধবার   ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ||  ফাল্গুন ৬ ১৪৩১

আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ-হত্যা: সঞ্জয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

কলকাতা সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২০, ২০ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১৭:৪৭, ২০ জানুয়ারি ২০২৫
আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ-হত্যা: সঞ্জয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

গ্রেপ্তার বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবী পুলিশ সঞ্জয় রায়।

কলকাতার বহুল আলোচিত মাল্টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল আরজি করে কর্মরত অবস্থায় চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দিল আদালত। ঘটনার ১৬৪ দিনের মাথায় সোমবার (২০ জানুয়ারি) রায় ঘোষণা করেন শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস। কারাদণ্ডের পাশাপাশি সঞ্জয়কে আরো ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও নিহত চিকিৎসকের পরিবারকে ১৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। 

এর আগে, গত শনিবার সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৬৪ (ধর্ষণের শাস্তি), ৬৬ (মৃত্যুর কারণ ঘটানোর শাস্তি) এবং ১০৩ (হত্যার শাস্তি) ধারায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। 

গোটা ভারতজুড়ে আলোড়ন ফেলে দেওয়া এই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় একমাত্র অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুদণ্ডই হতে চলেছে বলে ধারণা করেছিলেন প্রতিবাদীরা। কিন্তু এদিন রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারক অনির্বাণ দাস জানান, সঞ্জয় রায়য়ের অপরাধ ‘বিরলতম’ নয়। তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিচ্ছে আদালত। 

শনিবার মাত্র ১২ মিনিটের শুনানি শেষে এই মামলার রায় দিয়ে সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত। তখন জানিয়েছিল, সোমবার সাজা ঘোষণা করবেন আদালত।

এদিন ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল আদালত চত্বর। সাধারণ নাগরিকদের প্রবেশের অনুমতি ছিল না এদিন। সকাল ১০টা ৪০ মিনিট নাগাদ প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয় সঞ্জয়কে। এ সময় কোর্ট চত্বরে মোতায়েন করা হয় বিপুল-সংখ্যক পুলিশ বাহিনী। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ডিসি পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। ৮০ জন নারী পুলিশ কর্মকর্তাও ছিলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে।

শিয়ালদহ আদালতের ২১০ নম্বর কোর্টরুমে বিচারক অনির্বাণ দাসের এজলাসে ১২টা ২৫ মিনিট নাগাদ নিয়ে আসা হয় সঞ্জয়কে। সাজা ঘোষণার আগে প্রথা অনুযায়ী সঞ্জয়ের বক্তব্য জানতে চেয়ে বিচারপতি তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘‘ধর্ষণকালে আঘাতে মৃত্যু হয়েছে নির্যাতিতার।’’ এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে চান কি না। উত্তরে সঞ্জয় বলেন, ‘‘খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় আমি জড়িত নই। আমায় ফাঁসানো হয়েছে।’’

বিচারক বলেন, ‘‘নির্দোষ ছাড়া আর কিছু বলতে চান?’’ সঞ্জয় বলেন, ‘‘যে কাজটা আমি করিনি, তার জন্য আমাকে দোষী বলা হচ্ছে।’’ বিচারক পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে সঞ্জয় জানান, তার মা আছেন। কিন্তু বাড়ি থেকে কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। 

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ সময় কেঁদেও ফেলেন সঞ্জয়। বলেন, ‘‘আমি কোনোটাই করিনি। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আগের দিনও বলেছি। আমি শুনেছি, অনেক কিছু নষ্ট করা হয়েছে। আমার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ছিল। আমাকে মারধর করা হয়েছে। যার যা ইচ্ছা করছে। যেখানে খুশি সই করিয়ে নিচ্ছে।’’

এসব কথোপকথনের মাঝেই সিবিআইয়ের আইনজীবী এ সময় বলেন, ‘‘সঞ্জয় যে অপরাধ করেছে, তা বিরলতম। তার সর্বোচ্চ সাজা হওয়া উচিত।’’ 

পাল্টা সঞ্জয়ের আইনজীবী আদালতে সুপ্রিম কোর্টের একাধিক নির্দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘‘ওকে বাঁচানোর এটাই আমাদের শেষ সুযোগ। আপনার বিচারে যা সঠিক শাস্তি, তা-ই দিন। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দেবেন না। সিবিআই এটাকে বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা বলছে। মৃত্যুদণ্ড চাইছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের একাধিক নির্দেশে দেখা যাচ্ছে, বিরলের মধ্যে বিরলতম কোনটাকে বলা হয়। মৃত্যুদণ্ডের আগে পর্যাপ্ত প্রমাণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সে সব নির্দেশে।’’ প্রথমেই মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাতে দোষীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়, সে কথাও আদালতে বলেন সঞ্জয়ের আইনজীবী।

দু’পক্ষের কথা শোনার পর সাজা ঘোষণার জন্য আরো কিছুটা সময় নেন বিচারক। শুনানির পর আদালত কক্ষ ফাঁকা করে দিতে বলেন বিচারক অনির্বাণ দাস। দুপুর ২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ সাজা ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি। পরে বিকেল পৌনে তিনটে নাগাদ সাজা ঘোষণা করেন বিচারপতি। 

গত ৯ আগস্ট আরজি কর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সেমিনার হল থেকে নারী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার করা হয়। তাকে ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ। সেই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে। কলকাতা পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাকে। এরপর কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে তদন্তভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। 

গত ৭ অক্টোবর আরজি কর-কাণ্ডে প্রথম চার্জশিট জমা দেয় সিবিআই। সেখানে ধর্ষণ ও খুনের মামলায় আটক সিভিক ভলান্টিয়ারকেই মূল অভিযুক্ত হিসেবে দেখানো হয়। সিবিআইয়ের দাবির বিরোধিতা করে আদালতে অভিযুক্তের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, তার মক্কেল এই ঘটনার সঙ্গে যুক্তই নন। গোটা ঘটনাটি সাজানো। মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে অভিযুক্তকে। 

সিবিআই জানিয়েছিল, এই ঘটনার তদন্তে যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ মিলেছে, তাতে একজনই অভিযুক্ত। একজনের পক্ষেও যে ওই ঘটনা সম্ভব, তা বলা হয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের রিপোর্টেও। কয়েকদিন আগেই নতুন করে তদন্ত চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন নিহত চিকিৎসকের বাবা-মা। তাদের অভিযোগ ছিল, সিবিআই প্রমাণ লোপাট করছেন। 

১১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় আরজি করের ঘটনার বিচারপ্রক্রিয়া। টানা ৬০ দিন চলল শুনানি। আদালতে অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেছে সিবিআই। আরজি করের সেই ন্যক্কারজনক ঘটনার ১৬২ দিন পর ১৮ জানুয়ারি সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করে শিয়ালদহ আদালত। ২০ জানুয়ারি তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা  দিল আদালত।

রায়ে খুশি নন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

হত্যা মামলার তদন্তে খুশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতের রায়ে খুশি হতে পারেননি। যদিও মমতার সঙ্গে একমত নয় সাধারণ জনতা। তদন্ত প্রক্রিয়া ও তথ্য-প্রমাণ লোপাট নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ও পুলিশের দিকেই আঙুল তুলছে সাধারণ মানুষ। আদালতের রায় তাই খুশি করতে পারেনি সাধারণ মানুষকে।  

আরজি কর-এর এদিনের রায় নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা প্রথম দিন থেকেই ফাঁসির দাবি করে এসেছিলাম। আজও সেই দাবিতে অনড় আছি। কিন্তু আদালতের রায়ের ওপর আর কী বলব, আমি জানি না। আমরা ফাঁসির দাবি করে এসেছিলাম। বলেছিলাম, আমাদের হাতে এই মামলা থাকলে অনেক আগেই ফাঁসির নির্দেশ হয়ত দিয়ে দেওয়া যেত। ইচ্ছে করে এই মামলা কেড়ে নেওয়া হল আমাদের হাত থেকে। বাকিটা কী হয়েছে, না হয়েছে আমি জানি না। বলেছিলাম, আমরা করতে না পারলে সিবিআইকে দিন। এই নরপিশাচদের চরমতম শাস্তি হওয়া উচিত। আমি নিজে একজন আইনজীবী হিসেবেই এ কথা বলছি। বিস্তারিত নথি দেখিনি। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট নই। অন্তত ফাঁসির সাজা দিলে নিজের মনকে শান্ত করতে পারতাম।’’ 

আদালতের রায় নিয়ে সাধারণ মানুষ বলছেন, তদন্তের শুরু থেকেই তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছে পুলিশ। তাতে সহযোগিতা করেছে রাজ্য সরকার। সিবিআই যে সময়ে এই মামলা হাতে নিয়েছে, সেসময় অধিকাংশ তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়ে গিয়েছে; অনেক ক্ষেত্রে ঘটনা অন্য খাতে বইয়ে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক যোগ যোগসাজশের দিকে আঙুল তুলছেন সাধারণ মানুষ। 

এর আগে, নির্যাতিতার পরিবারের তরফেও জানানো হয়েছিল, গোটা তদন্তপ্রক্রিয়ায় তারা কোনভাবেই খুশি নয়। পুলিশ কিংবা সিবিআই, কারো ওপরেই আস্থা নেই তাদের। পরিবারের তরফে নির্যাতিতার মা-বাবা দুজনেই বারবার তদন্ত প্রক্রিয়া প্রভাবিত করা ও তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার জন্য অভিযোগের আঙুল তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের  দিকে। 

ঢাকা/সুচরিতা/এনএইচ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়