ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিক্ষার সর্বস্তরেই প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি : অধ্যাপক সেকুল ইসলাম

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩২, ২৬ জানুয়ারি ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিক্ষার সর্বস্তরেই প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি : অধ্যাপক সেকুল ইসলাম

অধ্যাপক সেকুল ইসলাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. সেকুল ইসলাম। তিনি একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রস্তাবিত এনার্জি ইনস্টিটিউটের পরিচালকও। তার মতে, প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া অনেক কিছুই অসম্ভব। কারণ এখন সবকিছুই মূলত প্রযুক্তিনির্ভর। তাই দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি এবং একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক। শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, শিক্ষার সর্বস্তরে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

রাইজিংবিডির এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আরো অনেক কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আবু বকর ইয়ামিন। পাঠকের জন্য চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরা হলো :

রাইজিংবিডি : বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা-ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ছোঁয়া কতটুকু লেগেছে বলে আপনি মনে করেন?

সেকুল ইসলাম : আমাদের সবকিছুই প্রযুক্তিনির্ভর। ক্লাসরুমে শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন, সেখানে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। অনলাইন পদ্ধতিতে লেকচার দিচ্ছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা অনলাইন পদ্ধতিতে লেকচার ডাউনলোডের মাধ্যমে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছে। এর সবই তো প্রযুক্তির কল্যাণ। উচ্চশিক্ষায় প্রযুক্তির ছোঁয়া অনেকটাই লেগেছে বাংলাদেশে। তবে দেশের উন্নয়নের জন্য এটির আরো অগ্রগতি প্রয়োজন। বিশেষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদান পদ্ধতি চালুর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছে সে অনুযায়ী দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যাবহার কতটা হচ্ছে?

দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তিবান্ধব অনেক বিভাগ ও ইনস্টিটিউট চালু হয়েছে। বিশেষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক বিভাগ রয়েছে। যেমন- কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিকস ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ফলিত রসায়ন ও কেমি-কৌশল বিভাগ, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। এসব বিভাগে বলতে গেলে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা দেওয়া হয়।

রাজনৈতিক সংকটে পড়াশোনার যে ব্যাঘাত ঘটছে সেটি মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত কোনো ব্যবস্থা আছে কি?

দেশে রাজনৈতিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে আসতে পারছে না। বিরোধী দল এখন তো হরতাল-অবরোধ দিচ্ছে না। আবার যদি হরতাল-অবরোধ শুরু করে, তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ছেড়ে যেতে পারবে না। শিক্ষার্থীরা পারবে না নিয়মিত ক্লাস করতে। এতে কোর্স সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সেশনজট তৈরি হতে পারে। এ সংকট মোকাবিলায় অনলাইন পদ্ধতিতেও শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। যাতে সেশনজট মোকাবিলা অনেকটা সম্ভব হবে।

অনলাইন পদ্ধতির সেবা কি সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে?

অনলাইন পদ্ধতিতে টিচিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। আমাদের সে প্রযুক্তি রয়েছে। যেমন, ওপেন ইউনিভার্সিটির কার্যক্রম তো সেভাবেই চলছে। তবে আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী সেটিকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারবে না। কারণ অনেক শিক্ষার্থী গ্রাম থেকে উঠে আসে। তবে ক্যাম্পাস তাদের সে সুবিধা দিতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিগত সেই ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তারা সহজে সেটিকে ব্যবহার করতে পারলেও এটি ব্যবহারের যে অর্থ, সেটি যথযথভাবে বহন করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিলে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে।

প্রযুক্তির ব্যবহার সহজলভ্য থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎপাদনশীল মনোভাব দেখা যায় না, এটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ছাত্রছাত্রীরা যাতে মানুষ হিসেবে তৈরি হতে পারে, সেটিই শিক্ষার মূল লক্ষ্য। আমাদের অধিকাংশ ছাত্র হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার থেকে আসা। প্রত্যেকের পরিবার পড়াশোনা শেষে একটি চাকরির অপেক্ষায় থাকে। এজন্যই তারা মূলত নতুন কিছু সৃষ্টির চেয়ে প্রথমে একটি চাকরির দিকেই নজর দেয় বেশি। এটিই হচ্ছে বাস্তবতা। তবে সব সময় নতুন কিছু সৃষ্টির মানসিকতা থাকা উচিত।

ঢাবি শিক্ষার্থীরা কতটুকু প্রযুক্তিবান্ধব শিক্ষাসেবা পাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে সময়োপযোগী পাঠদানব্যবস্থা চালু রয়েছে। যেমন আমাদের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ফলিত রসায়ন ও কেমি-কৌশল বিভাগ, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিকস ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিবান্ধব বিভাগ চালু রয়েছে। এসবের পাশাপাশি গবেষণা কার্যক্রমও রয়েছে। শিক্ষার্থীরা অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাসামগ্রী পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি এনার্জি ইনস্টিটিউট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে এর অগ্রগতি কতটুকু?

প্রস্তাবিত এনার্জি ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম এরই মধ্যেই শুরু হয়েছে। এ বছরের শেষের দিকে কিংবা আগামী বছরের প্রথম দিকে এর কার্যক্রম সম্পন্ন হতে পারে। শুধু এনার্জি ইনস্টিটিউট নয়, গত পাঁচ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। এর মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর এ ইনস্টিটিউটের ব্যাপারে সরকার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রস্তাব চেয়েছে। ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে ২০০ কোটি টাকা বাজেট হয়েছে। দেশীয় এনার্জির গবেষণা এখানে হবে। কনভেনশনাল ও নন-কনভেনশনাল এনার্জি এ ইনস্টিটিউটের অধীনে থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য যে শক্তি ইনস্টিটিউট রয়েছে, সেটিকে এনার্জি ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত করা হবে। এটিই হবে দেশের প্রথম এনার্জি ইনস্টিটিউট।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওয়্যারলেস সেবা চালু রয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রয়োজনীয়তা আছে কি?

বিশেষ কিছু জায়গায় এ সমস্যা রয়েছে। তা ছাড়া ক্যাম্পাসের অধিকাংশ জায়গায় ওয়াইফাই সেবা চালু রয়েছে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টেও চালু রয়েছে এই সেবা। হলভিত্তিক কয়েকটি ওয়াইফাই সেবা চালু রয়েছে। ওয়াইফাই, ওয়াইম্যাক্স এগুলো অনেক টাকাপয়সার ব্যাপার। প্রতিটি বিভাগ তাদের নিজস্ব ফান্ড থেকে এর ব্যাবহার করছে। এর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে আর্থিক সংকট আছে কি না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গরিব বিশ্ববিদ্যালয় বললেই চলে। এখনো ১০ টাকা বেতনে চলে। আমাদের সব সময় সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। আমাদের সে পরিমাণ অর্থ নেই। সরকার আমাদের ২০০ কোটি টাকা বার্ষিক বাজেট দিয়ে থাকে। এর ওপর ভিত্তি করে আমাদের চলতে হয়। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আমাদের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওয়াইফাই সেবা চালু রয়েছে। এর মূল কারণ তাদের পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। তারা তাই এর সঠিক ব্যবহার করতে পারছে।

ব্যবসায় অনুষদ যদি পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে এ সুবিধা দিতে পারে, তাহলে অন্যান্য অনুষদ দিতে পারবে না কেন?

ব্যবসায় অনুষদটির আয় অনেক। কিন্তু আমাদের সে পরিমাণ অর্থ নেই। তারা ইভিনিং এমবিএ কোর্সের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আয় করছে। একটি ইভিনিং এমবিএ কোর্সের মাধ্যমে ২ লাখ ২৬ হাজার টাকা আয় করতে পারছে তারা। আমাদের সে পরিমাণ আয় নেই। আয় থাকলে সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমার মনে হয়, এর জন্য বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা যেতে পারে। তাহলে আমরা অবশ্যই দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।

বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে যাচ্ছে। এটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

এটি ঠিক আছে। এসব র‌্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে একটি স্কেলিং করা হয়। আমাদের কিছু কমিউনিকেশন গ্যাপ আছে। বিশেষ করে, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ওয়েবসাইট, সেটি আপডেট নয়। যার কারণে দেখা গেছে, অনেক ইনফরমেশন সেখানে নেই। এটাকে টাইম টু টাইম আপডেট করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষকদের লেখা, বিশ্ববিদ্যালয় জার্নালগুলো, গবেষণা কার্যক্রমগুলো যদি নিয়মিত আপলোড করা যেত, তাহলে এজাতীয় সমস্যা মোটামুটি কাটিয়ে ওঠা যেত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মূলত প্রচারবিমুখ। মানুষ তিল হলে তাল বানিয়ে দেখায়। কিন্তু এখানে তাল হলেও তিল বানিয়ে দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। যার কারণে মূলত এসব সমস্যা হচ্ছে।  

দেশের অন্য স্কুল-কলেজগুলোতে প্রযুক্তির কেমন ব্যবহার হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এখন সব জায়গায় প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির সুবিধা পাচ্ছে। প্রাইমারি স্কুল লেভেল থেকে থেকে শুরু করে সবাই প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারছে। প্রযুক্তি এখন ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে চলে গেছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। পরীক্ষার ফলাফল দেখতে পারছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে পারছে। টাকাপয়সা লেনদেন করতে পারছে। এর সবই হচ্ছে প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য।

আপনাকে ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ রাইজিংবিডিকেও।



রাইজিংবিডি / ইয়ামিন / শামসুল / কে. শাহীন / ক.কর্মকার



রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়