ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

যেভাবে শেষ হলো তারেক-জোবায়দার দুর্নীতির মামলার বিচার

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪৬, ২ আগস্ট ২০২৩   আপডেট: ১৮:৫৪, ২ আগস্ট ২০২৩
যেভাবে শেষ হলো তারেক-জোবায়দার দুর্নীতির মামলার বিচার

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ৯ বছর ও তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

বুধবার (২ আগস্ট) দুপুরে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. আছাদুজ্জামানের আদালত এ মামলার রায় দেন।

নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো আলোচিত এ মামলার বিচার। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ, তা প্রত্যাহার, মামলার বিচার চলাকালে আওয়ামীপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের হাতাহাতি, মারামারি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য।

ঘোষিত আয়ের বাইরে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার মালিক হওয়া এবং সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ জহুরুল হুদা। মামলায় তারেক রহমান, জোবায়দা রহমান ও তার মা অর্থাৎ তারেক রহমানের শাশুড়ি ইকবাল মান্দ বানুকে আসামি করা হয়। মামলাটি তদন্ত করে ২০০৮ সালে দুদকের উপ-পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম তিন জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিট দাখিলের পর জোবায়দা রহমান মামলা স্থগিত এবং বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেছিলেন। হাইকোট মালাটি স্থগিত করে রুল জারি করেছিলেন। তবে বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা আবেদনটি শুনানি করে খারিজ করে দেন। এর ফলে দীর্ঘদিন মামলার বিচার বন্ধ ছিল।

২০২২ সালের ২৬ জুন হাইকোর্ট তারেক ও জোবায়দাকে ‘পলাতক’ ঘোষণা করে ৪ কোটি ৮২ লাখ টাকার দুর্নীতি মামলা দায়ের ও তার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে করা পৃথক রিট আবেদন খারিজ করে দেন।

রিট খারিজ করে দেওয়া রায়ে হাইকোর্ট একইসঙ্গে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দায়ের করা এ মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্ট নিম্ন আদালতকে যত দ্রুত সম্ভব বিচার কার্যক্রম শেষ করার নির্দেশ দেন। এছাড়া ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে এ রায় পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে মামলার রেকর্ড ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠাতে বলা হয়।

গত বছর ১ নভেম্বর আদালত তারেক রহমান ও জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তাদের আদালতে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়। গেজেট প্রকাশ করা হয়।  তারপরও তারা হাজির হননি। গত ২৯ মার্চ পলাতক এ দুই আসামির পক্ষে মামলার শুনানিতে অংশ নিতে আবেদন করেন অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার। ৯ এপ্রিল এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আদালত ১৩ এপ্রিল এ বিষয়ে আদেশের জন্য রাখেন। ১৩ এপ্রিল আদালত তারেক রহমান ও জোবায়দা রহমান আইনজীবী দিয়ে আইনি লড়াই চালাতে পারবেন না মর্মে তাদের আবেদন খারিজ করে দেন। ওই দিনই তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। একই সাথে সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ১৬ মে ধার্য করেন।

তবে প্রথম দিনেই কোনো সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হননি। এজন্য আদালত ২১ মে পরবর্তী তারিখ ঠিক করেন। ২১ মে মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ জহুরুল হুদা সাক্ষ্য দেন। ২৫ মে সাক্ষ্য দেন আরও দুজন। এরপর ২৮ মে কোনো সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেননি। এজন্য আদালত ২৯ মে সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেন। ২৯ মে এবি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন। এদিন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালতকে জানান, প্রতিদিন সাক্ষ্যগ্রহণের বিষয়টি দৃষ্টিকটূ। প্রতিদিন সাক্ষ্যগ্রহণ না করার অনুরোধ জানানো হয়। বিষয়টি দেখবেন বলে বিচারক তাদের জানান।

পরদিন আবারও মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রাখা হয়। ওইদিন বিকেল ৩টার দিকে এবি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন। তখন বিএনপিপন্থী এক আইনজীবী বিষয়টি আদালতকে মেনশন করেন। তখন রাষ্ট্রপক্ষের এক প্রসিকিউর ওই আইনজীবী বক্তব্য ভিডিও করছিলেন। এ নিয়ে দুইপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। যা একপর্যায়ে হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এমন পরিস্থিতিতে বিচারক এজলাস ছাড়েন। আওয়ামীপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালতে অবস্থান নেন। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বিচারক এজলাসে ওঠে ওই সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ করেন।

পরদিন আবারও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালতের সামনে অবস্থান নিয়ে মামলার বিচার বন্ধের স্লোগান দিতে থাকেন। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত হন আওয়ামীপন্থী আইনজীবী। দুইপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এদিন আদালত এক জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মামলার বিচার বন্ধের দাবি জানিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল, বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।

প্রতিপক্ষ হিসেবে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নিতেন। সংঘাত এড়াতে বাড়ানো হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। গত ১ জুন আরও দুই জন সাক্ষ্য দেন। ৪ জুন মামলা বাতিল, বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হুমকি দেয় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। ওই দিন ৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। পরদিন আরও একজন সাক্ষ্য দেন। ৬ জুন সাক্ষ্য দেন আরও ৪জন। আরও ৪জন সাক্ষ্য দেন ৭ জুন। ৮ জুন তিন ব্যাংক কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত।

এভাবে ৪ জুন থেকে ৮ জুন পর্যন্ত একটানা চলে সাক্ষ্যগ্রহণ। এরপর কয়েকদিন পর পর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।  ১১ জুন ২ জন, ২১ জুন আরও ২ জন, ৯ জুলাই ২ জন, ১৬ জুলাই ৫ জন, ২০ জুলাই ৩ জন এবং ২৪ জুলাই মামলার সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম সাক্ষ্য দেন।

মামলাটিতে ৫৬ সাক্ষীর মধ্যে ৪২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। তারেক রহমান ও জোবায়দা রহমান পলাতক থাকায় তাদের আত্মপক্ষ শুনানির তারিখ ধার্য না করে ২৭ জুলাই যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ ধার্য করেন আদালত। ২৭ জুলাই দুদকের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের তারিখ ২ আগস্ট ধার্য করেন। ২ আগস্ট রায়ে দুই আসামিকে সাজা দিলেন আদালত।

২ আগস্ট যেমন ছিলো আদালতপাড়া : 
রায়কে কেন্দ্র করে আদালতপাড়ায় বাড়ানো হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। সকাল থেকেই মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে অবস্থান নেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। মাথায়, মুখে তালো কাপড়, হাতে কালো পতাকা নিয়ে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তারা আন্দোলন চালিয়ে যান। দুপুর ১২ টার দিকে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের পাশে এসে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। টান টান উত্তেজনা দেখা যায়। অবশ্য সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ।

এদিকে, দুপুরের দিকে জানা যায়,  বেলা  তিনটার দিকে আদালত মামলার রায় ঘোষণা করবেন। দুইপক্ষের আইনজীবী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অবস্থান নিতে থাকেন আর বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। বিচারক যখন রায় পড়ছিলেন তখনও তারা বাইরে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। ৪টার দিকে আদালত রায় ঘোষণা করেন। রায় শুনে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ভুয়া বলে স্লোগান দেন। আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এরই মাঝে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আদালত প্রাঙ্গণ। ধাক্কাধাক্কিতে জড়িয়ে পড়ে দুইপক্ষ। মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে মিডিয়ার সামনে ব্রিফ করে মহানগর দায়রা আদালত প্রাঙ্গণ থেকে চলে যান বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। পরে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।

দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল, মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু মিডিয়ার সামনে আসেন ব্রিফ করতে। তখন দেখা যায় চরম বিশৃঙ্খলা। আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা বলতে থাকেন, তারা আন্দোলনে ছিলেন, তারা মিডিয়ার সামনে আসবেন। তারা আন্দোলনে ছিলেন না তারা সরে যান। কিন্তু সবাই ক্যামেরায় মুখ দেখাতে সামনে এসে ভিড় করেন। এতে বিরক্ত হয়ে মোশাররফ হোসেন কাজল ও আব্দুল্লাহ আবু সরে যান। পরে অবশ্য ব্রিফ করেন তারা দুইজন। রায়ে তারা সন্তোষ প্রকাশ করেন।

উল্লেখ্য, উচ্চ আদালত ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম বাতিল করেন।

/মামুন/এসবি/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ