সাহেবী খাবারের সঙ্গে ঐতিহ্য ফ্রি
জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম
খাবারের ঐতিহ্য আর ঐতিহ্যের সঙ্গে খাবার। পুরনো ঢাকার বেচারাম দেউরী জমিদার বাড়িতে এই দু’য়ের সম্মিলন ঘটেছে। রাজধানীর ‘জমিদার সাহেব বাড়িতে’ চালু হয়েছে লাঞ্চ এট হেরিটেজ হোম।
বাড়িটির বয়স প্রায় দুইশ বছর। বাহারি নকশা, লাল রঙের আর্মেনীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। মহল্লার মানুষ বাড়িটিকে ‘সাহেব বাড়ি’ নামেই চেনে। অনেকে বলেন ‘জমিদার বাড়ি’। সব মিলিয়ে জমিদার সাহেব বাড়ি। এমন একটি বাড়ির একাংশে চালু হয়েছে ব্যতিক্রমী এক রেস্তোরাঁ। যেটি এখন পরিচিত ইমরানস হেরিটেজ হোম নামে। এখানে মিলবে পারিবারিক আবহে রকমারি ঢাকাই খাবারের স্বাদ। সঙ্গে ভোজন রসিক পাবেন ঐতিহ্যের সংস্পর্শ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাহেব বাড়ির এক সময় আতিথেয়তার সুনাম। ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থে নাজির হোসেন-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, পুরনো ঢাকার বেচারাম দেউড়িতে উনিশ শতকের মাঝামাঝি ছয় বিঘা জমির ওপর বাড়িটি তৈরি করেছিলেন ঢাকা ও সোনারগাঁয়ের তৎকালীন জমিদার মৌলভি আবুল খায়রাত মোহাম্মদ।
‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে মুনতাসির মামুন লিখেছেন, জমিদার আবুল খায়রাত মোহাম্মদের প্রথম পুরুষ মুন্সী আলম। ইয়েমেনে তার জন্ম। মুন্সী আলমের দুই ছেলের একজন মুন্সী গুল বকস, আরেকজন মুন্সী নূর বকস। এই নূর বকসের ছেলে আবুল খায়রাত মোহাম্মদ। যার দুই ছেলের একজন আবুল হাসনাত ও আরেকজন আবু জাফর জিয়াউল হক ওরফে নাবালক মিয়া। নাবালক মিয়ার ছয় ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে এম এ জাহাঙ্গীরের ছেলে এ এম ইমরান। বাড়িটির পাশের চারটি সড়কের নাম এই পরিবারের চার সদস্যের নামে- নূর বকস রোড, আবুল খায়রাত রোড, আবুল হাসনাত রোড ও নাবালক মিয়া লেন। নাবালক মিয়া লেনের শেষ মাথায় এই বাড়ির অবস্থান।
বাড়িটির দুটি অংশ- বাহিরমহল ও অন্দরমহল। গত শতকের পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে দুই মহলের সামনের প্রশস্ত বাগানের মধ্য দিয়ে দুই পরিবারের সদস্যরা দেয়াল তুলে দেন। বর্তমানে বাহিরমহলের অভিভাবক নাবালক মিয়ার নাতি এ এম ইমরান। অন্দরমহলে বসবাসরত আবুল হাসনাতের বংশধরেরা সম্প্রতি তাদের অংশের পুরনো স্থাপনা ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। ইমরান সেই পথ মাড়াননি; বরং প্রাচীন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এবং বিকল্প কিছু করার অভিপ্রায় থেকে চালু করেছেন চমকপ্রদ এই রেস্তোরাঁ।
ইমরান একে রেস্তোরাঁ বলতে নারাজ। বাহিরমহলে গিয়ে চোখে পড়ে কাচের কারুকাজ করা নকশাদার স্তম্ভ, উঁচু সিলিংয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বড় বড় দরজা-জানালা, নকশাদার রেলিং। বিশাল হলরুমে সাজিয়ে রাখা শতবর্ষী আসবাব। সেখানে শোভা বাড়াচ্ছে তুরস্ক থেকে আনা পুরনো ঝাড়বাতি। সোনার প্রলেপ দেয়া দুইশ বছরের পুরনো পবিত্র কোরআন শরিফ, মরচে পড়া তলোয়ার, হাতে লেখা ফারসি পুস্তক, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা আতরদানি, খাবার থালা বাসন, পানদান, শুরা পাত্র। দুষ্প্রাপ্য সব ছবি ও শিল্পকর্মসহ নানা উপকরণ বাড়িটির ঐহিত্যের জানান দিচ্ছে। এর পাশেই খাবার ঘর। ভবনের পরের অংশটুকু নতুন করে বানানো। যত্ম করে রাখা আছে পূর্ব পুরুষদের আঁকা ছবির অ্যালবাম। আরো আছে সেসময় আসা রাজনীতিকদের ছবি।
কথায় কথায় জানা গেল, একসময় এই বাড়িতেই আতিথেয়তা নিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ বাড়িতে বসেই লিখেছেন ‘বিষের বাঁশি’ কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতা। তারও আগে এই বাড়িতে অসংখ্যবার এসেছেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথায় এই বাড়িটির উল্লেখ রয়েছে। পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্টের কয়েকটি বৈঠক এই বাড়িতেই হয়েছে।
কালের নানা ঘটনার সাক্ষী সাহেব বাড়ির এই অংশকে রেস্তোরাঁয় রূপ দেয়ার কারণ জানতে চাইলে ইমরান বলেন, ‘মূলত সৌন্দর্য, আতিথেয়তা ও বিভিন্ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের আনাগোনার কারণে আমাদের এই বাড়ি বিখ্যাত হয়েছিল। এছাড়া আমাদের বাড়ির আরেকটি ঐতিহ্য হলো, আমরা প্রতি বেলা খাবারের মেন্যুতে ভিন্নতা রাখি। রেস্তোরাঁ বা গেস্ট হাউজ চালুর আগে এখানে অনেক দেশের কূটনীতিক এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও আসেন। ফলে স্থাপত্য নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাকে পরামর্শ দেয়া হলো এমন ধরনের কিছু একটা করার, যাতে আয়ের পাশাপাশি ভবনের ইতিহাসও ধরে রাখা যায়। আমিও বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবেই দেখি।’
ইমরান জানান, ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি যাদের আলাদা টান আছে, তারাই মূলত এখানকার ভোক্তা। দর্শনার্থীরা এখানে আসেন, সবকিছু ঘুরে দেখেন, পরিবারের সদস্যদের রান্না করা খাবার পারিবারিক প্রতিবেশে উপভোগ করেন। এখানে বাণিজ্যিক ব্যাপারটা মুখ্য নয়। খাবার খাওয়া একটা উপলক্ষ্য মাত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য কলা বিভাগের দুই শিক্ষার্থী অশ্বিনী কুমার ও মৃদুল রায় বাড়িটি দেখতে এসেছিলেন। তারা বলেন, ‘আমাদের ধারণা, কোনো ঐতিহ্যবাহী ভবনকে কেন্দ্র করে এমন উদ্যোগ বাংলাদেশে প্রথম। এখানে এসে ঐতিহ্য ও আতিথেয়তার মিশেলে যে চমৎকার অভিজ্ঞতা হলো, তা আমরা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করব।’
ইমরানের এই উদ্যোগের পিছনে উৎসাহদাতা ছিলেন আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ইমরান আমাদের সামনে একটা উদাহরণ তৈরি করতে পেরেছেন। পুরনো ভবন রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরও কিছু ভবন যদি এমন ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা যায়, তাহলে ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি ভবন মালিকদের আয়ের একটা পথও তৈরি হবে।’
প্রতিদিন দুপুরে অতিথিদের জন্য পরিবেশন করা খাবারের তালিকায় রয়েছে জাফরানি পোলাও, আনারস ইলিশ, মুরগির মাংসের চপ, মুরগির রোস্ট, বিফ কাটা মসলা, চিংড়ি মাছের মালাই কারি, সালাদ এবং ঘরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বানানো বোরহানি এবং শেষে জাফরানি জর্দা ও স্পেশাল চা। ইমরান জানান, রাতের অতিথিদের জন্য আলাদা বন্দোবস্ত থাকে। এই বাড়িতে এক দিনে একই মেন্যু দুবার পরিবেশনের রেওয়াজ নেই।
এখানে খেতে হলে যোগাযোগ করতে হবে ন্যূনতম তিনদিন আগে। সর্বনিম্ন পাঁচজন ও সর্বোচ্চ ২০ জনের একটা দলের জন্য দুপুর অথবা রাতের খাবারের ফরমাশ করা যাবে। ফরমাশের জন্য Lunch at Emran’s Heritage Home ফেসবুক পেজে যেতে হবে।
ঢাকা/তারা
রাইজিংবিডি.কম