‘দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হলেই ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব’
‘রাজধানী ঢাকার টেকসই উন্নয়নে বিকেন্দ্রীকরণ ও পরিবেশ সুরক্ষা’ শীর্ষক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদী দখল ও দূষণ, পরিবেশ দূষণ, পলিথিনের উচ্চ ব্যবহার এবং অসহনীয় যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় বসবাস ক্রমাগতভাবে অসহণীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থা উত্তরণে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে সারা দেশের টেকসই উন্নয়ন জরুরি বলে অভিমত দিয়েছেন ডিসিসিআই আয়োজিত ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারীরা।
শনিবার (২৩ আগস্ট) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘রাজধানী ঢাকার টেকসই উন্নয়নে বিকেন্দ্রীকরণ ও পরিবেশ সুরক্ষা’ শীর্ষক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
রাজধানীর মতিঝিল ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম।
সভার ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “২০২২ সালে বুয়েট পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার প্রতিদিন যানজটের জন্য ১৪০ কোটি টাকার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “ঢাকার ওপর চাপ হ্রাস ও বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক কাজের ঢাকার আশেপাশের শহরগুলোকে সেকন্ডোরি শহর তৈরি করতে হবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য ও টেকসই মহানগর হিসেবে গড়ে তোলতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই।”
পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “দেশের জলবায়ু পরিবর্তন ঢাকার বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে আরো প্রকট করছে। সারা দেশের টেকসইয়ের উন্নয়ন করতে হলে, তা সমাজ থেকে আসতে হবে, যেটা আমাদের মধ্যে বেশ অভাব রয়েছে।”
তিনি বলেন, “পলিথিন ব্যবহার কমাতে গত এক বছরে অনেক ঝুঁকি মোকাবিলা করে বেশকিছু কাজ করেছি। এখন সরকারি অনেক সংস্থাও এগিয়ে আসছে এবং আশা করছি ভবিষ্যতে ভালো ফল পাওয়া যাবে।”
পরিবেশ দূষণমুক্ত চাইলে দূষণকারী শিল্প-কারখানা বন্ধ করতে শিল্প-উদ্যোক্তাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা আরো বলেন, “ঢাকায় জনসংখ্যা কাঙ্খিত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ রাখা বেশ কষ্টসাধ্য এবং বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে ঢাকার আশেপাশের শহরগুলোকে স্যাটেলাইট শহর হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। পুরোনো কাঠামো, লোকবল এবং প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করে, নতুন বাংলাদেশ উপহার দেওয়া বেশ কঠিন।”
পরিবশে উপদেষ্টা জানান, ঢাকা শহরের আশেপাশে ৪টি নদীসহ সার দেশে ১৩টি নদী দখল ও দূষণ মুক্ত করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং এ কাজে দাতা সংস্থাগুলো সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
রাজউকের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম বলেন, “টেকসই ঢাকা তৈরি করতে হলে পুরো বাংলাদেশকেই টেকসই করতে হবে, যা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হিসেবে রাজধানী শহরের কোন বিকল্প উৎস নেই, এর ওপর চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং ভবিষ্যতেও এটা কমার সম্ভাবনা প্রতিফলিত হচ্ছে না। ঢাকার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই। সেই সাথে সব ধরনের উন্নয়নের কার্যক্রম একটি সংস্থার আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করেন। যার মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের নগর জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ রাজধানীতের বসবাস করলেও ঢাকার সবুজায়নের অভাব এবং উষতার বৃদ্ধির কারণে এখানকার জীবনযাপন বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে।”
তিনি বলেন, “অতিকেন্দ্রিকতার কারণে ঢাকায় বন্যা, জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি, বর্জ্য অব্যবস্থাপনার সংকট, নগর দূষণ এবং জনস্বাস্থ্য সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে।”
বিশেষ করে দেশের নদীগুলোর সুরক্ষার জন্য তিনি নদী কমিশনের সক্ষমতা ও আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণে সুষম নগরায়ন ও শহরের বিকেন্দ্রীকরণ ও গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।
আলোচনায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশসের (ডিএনসিসি) ভুগোলবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদ দিলবাহার আহমেদ, রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া, ডিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সহ-সভাপতি এম. আবু হোরায়রা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালযের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক, রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম, স্থাপত্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. জিয়াউল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম অংশ নেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “ঢাকার উন্নয়নকে মহানগরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে, এজন্য দেশের প্রান্তিক এলাকাগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়ন করতে হবে।”
রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, “ঢাকার রাস্তায় যান্ত্রিক ও অ-যান্ত্রিক যানবাহন চলার কারণে অসহনীয় যানজট হয়ে থাকে, এর দ্রুত প্রতিকার প্রয়োজন।”
তিনি রাজধানীর বাইরে সব নাগরিক সুবিধা সম্বলিত স্যাটেলাইট শহর তৈরির ওপর জোরারোপ করেন এবং এ খাতে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন।”
বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, “গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন না করে আমরা মেগা পরিকল্পনার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের ব্যয় বেড়েছে, যদিও তা জনগণের কাজে আসছে না।”
দেশের সমন্বিত উন্নয়নের জন্য সুষম পরিকল্পনার কাঠামোগত সংষ্কার প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, “৩টি রিং রোডের মাধ্যমে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, ঢাকার চাপ কমাতে সাভার ও গাজীপুরকে স্যাটেলাইট শহরে হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।”
সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ কাজী গোলাম নাসির বলেন, “১৫২৮ বর্গকিলোমিটারের ঢাকা শহরের পরিকল্পনার জন্য দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে, খণ্ডিত পরিকল্পনার কোন সুযোগ নেই, তাই সার্বিকভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন একান্ত অপরিহার্য।”
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকত জহিরুল ইসলাম বলেন, “ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত রয়েছে, তবে এর বাস্তব সমাধানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।”
ঢাকা/নাজমুল/সাইফ