ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

তথ্য কমিশনেও মিলছে না তথ্য

জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫১, ৬ জুন ২০২২   আপডেট: ১৮:১০, ৬ জুন ২০২২
তথ্য কমিশনেও মিলছে না তথ্য

ফাইল ছবি

তথ্য প্রাপ্তির অন্ধকার কাটাতে তথ্য অধিকার আইন করেছে সরকার। একজন সংবাদ কর্মীর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার শেষ ঠিকানা তথ্য কমিশন। তবে সেই তথ্য কমিশনে অভিযোগ করেও মিলছে না তথ্য। 

মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে (২০১৬) অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের নির্বাচনী হলফনামার তথ্য চাইতে গিয়ে সম্প্রতি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আবেদন, আপিল ও অভিযোগ করেও প্রার্থীদের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং এমন তথ্য প্রকাশ হলে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুন্ন ও শারীরিক নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের প্রত্যেকের হলফনামায় তাদের সম্পদের বিবরণ, আয়-ব্যয়, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খতিয়ানসহ নানা বিষয়ের বিবরণী থাকে। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বরাবর দাখিল করা হয় এসব হলফনামা।

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর দাখিলকৃত হলফনাফা হলো একজন প্রার্থীর পরিচ্ছন্নতার মাপকাঠি। আর এসব হলফনামার তথ্য প্রাপ্তির জন্য তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেও তথ্যের নিশ্চয়তা মিলছে না। এতে অন্ধকারেই রয়ে গেল মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামা। তথ্য কমিশনে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।

গেলো জেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের দাখিলকৃত হলফনামা, নির্বাচনী ব্যয় ও ব্যক্তিগত সম্পদের তথ্য চেয়ে বিগত বছরের ২০ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ এবং জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্য প্রদাণকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ.বি.এম আরিফুল হক বরাবর আবেদন করেন রাইজিংবিডির মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জাহিদুল হক চন্দন।

এর জবাবে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্য প্রদাণকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ.বি.এম আরিফুল হক ই-মেইল মারফত এই প্রতিবেদককে জানান, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ হলে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন ও শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হতে পারে। এই কারণে তথ্য অধিকার আইনের ২০০৯ এর ধারা ৭এর উপধারা জ ও ঝ অনুযায়ী তথ্য প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। 

পরে এ প্রতিবেদক ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আপিল করলে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শুনানী গ্রহণ করা হয়। এ কার্যালয় থেকেও তথ্য প্রদানের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। এছাড়া সঠিক কারণ ও সুস্পস্ট করে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করার পরেও তথ্য কমিশন অভিযোগ পর্যালোচনা করে শুনানী গ্রহণ ছাড়াই ডাকযোগে একই সিদ্ধান্ত জানান।

তথ্য উপাত্ত থেকে জানা গেছে, যখন কোনো প্রার্থী পাবলিক অথরিটির কাছে তথ্য প্রদান করেন, সেগুলো স্বাভাবিকভাবে ‘পাবলিক ইরফরমেশন’। জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিলকৃত হলফনামা, নির্বাচনী ব্যয় ও ব্যক্তিগত সম্পদের বিবরণী পাবলিক ইনফরমেশন। এসব তথ্য ‘পাবলিক ইনফরমেশন’ যা তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী যে কোনো নাগরিক পেতে পারেন। উচ্চ আদালতের রায়ে যে কোনো ‘কর্তৃপক্ষের’ কাছে থাকা পাবলিক ইরফরমেশন সেই কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের দিতে বাধ্য (Badiul Alam Mujumder vs information Commission and others,69 DLR(2017))।

নির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্যাবলী প্রদান রিট পিটিশন নম্বর-২৫৬১/২০০৫ এর প্রেক্ষিতে মাননীয় হাইকোর্ট ২০০৫ সালের ২৪মে প্রার্থীদের আট ধরনের তথ্য প্রদান ও প্রচারের নির্দেশনা দিয়েছেন। মাননীয় হাইকোর্টের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে জনৈক ব্যক্তি আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করার পরও মাননীয় আদালত হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখেন।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সভায় প্রার্থীর হলফনামা, নির্বাচনী ব্যয়ের উৎসের বিবরণী, আয়কর রিটার্ন ও কর পরিশোধের প্রমাণের ফটোকপি এনজিওসহ যে কেউ যেন নিতে পারেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তথ্য অধিকার আইন নিয়ে কাজ করা ডেইলি স্টারের সাবেক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তাওফিক আলী এ বিষয়ে বলেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার মূল চেতনা এবং উদ্দ্যেশ্যই হলো গণতান্ত্রিক পন্থায় একটি স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত জাবাবদিহিতার প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করা। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরেও রিটার্নিং কর্মকর্তা একজন নির্বাচনী প্রার্থীর এসব তথ্য কেনো গোপন রাখবেন এবং ভোটার বা জনগণ কেন তা জানতে পারবেন না, তা বোধগম্য নয়। জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য না দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে তথ্য কমিশন গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে একটি হতাশাজনক নজির স্থাপন করেছে।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর দাখিলকৃত হলফনাফা হলো একজন প্রার্থীর পরিচ্ছন্নতার মাপকাঠি। হলফনামা প্রার্থীর ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য হতে পারে না। একজন প্রার্থী যখন ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তখন তার নিজের সম্পর্কিত তথ্য হলফনামা আকারে জানাতে হবে। যখন কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন, তখন তিনি পাবলিক ফিগার হয়ে যান। তাদের সম্পর্কে মানুষ জানতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তথ্য কমিশন প্রার্থীর হলফনামার তথ্য দিতে কেন সিদ্ধান্ত দেননি, বিষয়টি আমার কাছে বোধগম্য নয়। নির্বাচনে প্রার্থীদের দাখিলকৃত হলফনামার তথ্য অবশ্যই প্রকাশযোগ্য তথ্য।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা আকারে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খতিয়ান, আয়ের উৎস, নিজেদের এবং নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদ ও দায়দেনার তথ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের ক্ষমতায়িত করা। নাগরিকদের এ ধরনের তথ্যভিত্তিক ক্ষমতায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। জেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের দাখিলকৃত তথ্য পাওয়া যেকোনো নাগরিকের অধিকার। এসব প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশ হলে ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন ও শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হতে পারে এমন কারণে তথ্য না দেওয়া দায়িত্বে অবহেলার সামিল। তথ্য কমিশনে অভিযোগের পরও তথ্য না দেওয়া আরও দুঃখজনক। কারণ, প্রার্থীদের দাখিলকৃত তথ্য জনগণকে জানানোর জন্যই রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করা হয়। পাবলিক অথরিটি হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তা তা জনগণের মাঝে সরবরাহ করবেন- এমন নির্দেশনা দেওয়া আছে।’

তবে জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিলকৃত তথ্য পাবলিক ইনফরমেশন নাকি ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য এমন প্রশ্নের জবাব দেননি তথ্য কমিশনার সুরাইয়া বেগম এনডিসি।

মানিকগঞ্জ/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়