ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

সাধু পুরুষ, খারাপ মেয়ে ও আলামত তত্ত্ব

জাফর উল্লাহ সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০২, ২০ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাধু পুরুষ, খারাপ মেয়ে ও আলামত তত্ত্ব

প্রতীকী ছবি

জাফর উল্লাহ সোহেল: ফেসবুক যদি না থাকত, জানি না এ সত্যের কতখানি জানা যেত। এই যোগাযোগ মাধ্যমটিতে বাংলাদেশের এত এত শ্রেণির এত এত মানুষ আজকাল নিজেদের প্রকাশ করেন এবং বলা যায় করতে পারেন, অন্য কোন মাধ্যমেই তা কখনো হয়নি কিংবা বলা যায় সম্ভব হয়নি। ক’জন এই কথাটা বিশ্বাস করবেন জানি না- আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের মনস্তÍত্ত্ব আগের তুলনায় বেশি করে নগ্নভাবে ফুটে উঠছে এই ফেসবুকের কল্যাণে। আগের তুলনায় বেশি করে পরিচিত মানুষদের ভেতরটা দেখারও একটা সুযোগ করে দিয়েছে এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনায় এদেশের মানুষের বিশেষ করে পুরুষ শ্রেণির মনোজাগতিক চিন্তাকে একেবারে উলঙ্গ করে আমাদের সামনে এনে দিচ্ছে এই ফেসবুক বা ‘মুখবই’। আমরা অনেকেই আশ্চর্য হয়ে মানুষের ভেতরের এই রূপ দেখছি আর ভাবছি- এই দেশের মানুষ এইরকম চিন্তা করে ? আমার বন্ধু, প্রতিবেশী, পরিচিতজন- এরা এইরকম ভাবে? কী ভয়ানক ব্যাপার!

আগে একসময় মনে করা হতো সমাজের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু অশিক্ষিত বা কমশিক্ষিত তাদের কাছ থেকে সব বিষয়ে সঠিক বক্তব্য বা যথাযথ মতামত পাওয়া যাবে না। সেজন্য যে কোন বিষয়ে একটু জানাশোনা লোকেরাই সিদ্ধান্ত দিত এবং মতামত নেয়াও হত তাদের কাছ থেকেই। কিন্তু এখন তো সবাই মোটামুটি শিক্ষিত, সবাই জানে। এরপরও কি কোন বিষয়ে সঠিক জনমত উঠে আসছে? অন্যভাবে যদি বলি প্রত্যাশিত মতামত মিলছে? আমার কাছে মনে হয়, মিলছে না।

বনানীর ধর্ষণ ঘটনায় ৬০ শতাংশের ওপরে মানুষ ফেসবুকে বলেছে, এখানে মেয়েদের দোষ বেশী। অন্তত এ ক’দিন ফেসবুকে হাজার খানেক আইডি ঘোরাঘুরি করে এমনটিই মনে হয়েছে আমার। বেশির ভাগ আইডি অবশ্যই পুরুষের, তবে কিছু মেয়ে আইডিও এই তালিকায় আছে। আছেন সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা। সিংহভাগ মানুষের মনে কেবল প্রশ্ন আর প্রশ্ন- কেন মেয়েরা হোটেলে গেল, কেন রাত ১২টা/১টা/২টায় সেখানে গেল, কেন মেয়ে মানুষ ফুর্তি করতে গেল, কেন বাসায় জানিয়ে গেল না, কেন ধর্ষণের ঘটনা হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানালো না, কেন পরের দিনই থানায় মামলা করল না, কেন ৪০ দিন পরে থানায় গেল, কেন সাফাতের আগের স্ত্রী এখানে যুক্ত হল? নিশ্চয়ই এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত, নিশ্চয়ই অনেক বড় আর্থিক লেনদেনের বিষয় ছিল, নিশ্চয়ই বনিবনা হয়নি বলেই মামলা করতে গেছে, নিশ্চয়ই মেয়েদের পরিবারও খারাপ, নিশ্চয়ই এরা বনিতা- ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

মূল বক্তব্য কী? মূল বক্তব্য হল- এই যুগের ধর্ষক সাফাত-নাইমরা ‘সাধু পুরুষ’, আর ধর্ষণের শিকার মেয়েরা ‘খারাপ মেয়ে, বারবনিতা।’ সাধু পুরুষদের বক্তব্য হল- ‘রাতের বেলা তুমি মেয়ে মানুষ হয়ে পুরুষের সামনে যাবা আর ধর্ষিত হবা না, তা কী করে হয় বাপু? ছেলেদের এখানে কী দোষ, তারা তো প্রকৃতির ডাকে কেবল সাড়া দিয়েছে! আর একটু আধটু জোর করলে তাকে তুমি ধর্ষণ বলছ কেন, এ না হলে কি জমে?’ খবর যারা দেখেন, তারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সাধু পুরুষ সাফাতের এই বক্তব্য মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পেরেছেন।

আমার প্রশ্ন হল- প্রিয় ভাই, বন্ধু, স্বজন, প্রতিবেশী, পরিচিত মুখেরা- আপনারা কি এই সাধু পুরুষ আর খারাপ মেয়ে তত্ত্ব সেদিন মেনে নেবেন, যেদিন আপনার নিজের বোনটি বা মেয়েটি বা আপনজন এমন ঘটনার মুখোমুখি হবে? সেদিন কি আপনি পরিষ্কার গলায় বলতে পারবেন আমার বোন বারবনিতা। বলতে পারবেন ? উত্তরটা ভেতরে ভেতরে সাজিয়ে নিন। আপনাকে সময় দিলাম। কারণ, আমি নিশ্চিত, হুট করে আপনি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। আমাদের কাছে যত দোষ কেবল নন্দ ঘোষের, নিজের বেলায় আসলে সেটা দোষ কি না আগে সে চিন্তা করতে হয়! সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, আগে তো ঘটনাটা কী দাঁড়ায় তা দেখুন, কী সত্য বেরিয়ে আসে তা জানুন। বনানীর মেয়ে দুটি যেমন খারাপ হতে পারে তেমনি নাও তো হতে পারে। আগে থেকেই কেন তাদের চরিত্র হনন শুরু করে দিতে হবে ?
 
কেউ কেউ কল্পনা শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে মেয়েদের হোটেলে যাওয়ার সময়কে রাত ১০টা থেকে টানতে টানতে ২টায় নিয়ে ঠেকিয়েছেন; কেউ কাল্পনিকভাবেই তাকিয়ে দেখতে পেয়েছেন মেয়েদের অতীতে বহুগামিতার বহু আলামত; অনেকে বড়লোকের ছেলের পেছনে লাগিয়ে দেয়ায় এমনকি পরিবারেরও উৎসাহ দেখতে পেয়েছেন; অনেকে আবার বলতে চেয়েছেন এখানে আসলে কিছুই হয়নি, পুরোটাই সাফাতের প্রাক্তন স্ত্রীর কারসাজি!
এখন তো আসামিরা এক ধরনের স্বীকারোক্তি দিয়ে দিয়েছে। সে রাতে কী হয়েছিল হোটেল রেইনট্রিতে, কীভাবে ভিডিও হয়েছিল, কীভাবে প্ল্যান করে মেয়েদের নিয়ে আসা হয়েছিল-  বলে দিয়েছে। এখন আপনারা কী বলবেন?
আসলে যারা এরকম বলেন, তারা এ ঘটনা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়ে গেলেও ষড়যন্ত্র খুঁজে পাবেন। কারণ, তারা আসলে এমনই; একেকজন ‘সাধু পুরুষ’। নিজের ঘরের মেয়ে ছাড়া দুনিয়ার সব মেয়েই তাদের চোখে ‘খারাপ মেয়ে’। খারাপ মেয়েদের ধর্ষণ করা আপনাদের কাছে জায়েজ। যেমনটা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে ছিল জায়েজ এবং তারা তা করেছে।

যাক, আশার কথা হল ‘খারাপ মেয়ে’দের কথায় বাংলাদেশের পুলিশ শেষমেষ সায় দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাদের বক্তব্য মেনে ধনীর দুলাল আসামিদের গ্রেপ্তার করেছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে- সবশেষ আসামি হিসেবে নাইম আশরাফকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রিমান্ডে থাকা প্রধান আসামি এরই মধ্যে ১৬৪ ধরায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতেও একবার রাজি হয়েছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ করেছেন অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকেরা। সাফাতের গাড়ি চালক বিল্লালও ধর্ষণ ঘটনার ভিডিও করেছে বলে স্বীকার করেছে। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে এগুচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।

মনে হচ্ছে বলছি কারণ, দেশে বিচার ব্যবস্থায় এত দীর্ঘসূত্রতা আর আইনে এত ফাঁকফোকর যে, শেষ পর্যন্ত অপরাধীরা সঠিক শাস্তি পাবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েই যায়। বিশেষ করে এই ঘটনায় যখন বারবার উঠে আসছে আলামতের বিষয়টি। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার মেয়েদের শারীরিক পরীক্ষায় সে ঘটনার আলামত পাওয়া যাবে কি না, এ প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে বেশিরভাগের মত হল, পাওয়া যাবে না। কারণ, সময় বেশি পার হয়ে গেছে।
আমি জানি না এসব মামলায় ধর্ষণের আলামতই প্রধান বিবেচ্য কেন হবে। কয়েকজন আইনজীবী বন্ধুর সাথে কথা বলে জানলাম- এটাই একমাত্র বিবেচ্য নয়। আদালত যদি ভিকটিমের বক্তব্য এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্যে মিল পান সেখান থেকেও অপরাধ প্রমাণ হয়েছে ধরে নিতে পারেন। তবে, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে কেন জানি আলামতকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। আলামত না থাকলে প্রায়ই ভিকটিমের বক্তব্য আমলে নেয়া হয় না।

আমার সংশয় এবং আপত্তি এখানেই। বনানী ধর্ষণ ঘটনায় আসামিরা বলেই দিয়েছেন, এখানে যৌন সংসর্গ হয়েছে। তাহলে আর শারীরিক আলামতের প্রয়োজন কেন? এখন তো কেবল প্রমাণ করতে হবে ধর্ষণ বা জোর পূর্বক এই যৌনক্রিয়া হয়েছে কি হয়নি, সে বিষয়টি। আলামতের বিষয়টি তো এখন এই মামলার সম্ভাব্য বিবেচ্য বিষয়সমূহের তালিকা থেকেই বাদ দেয়া উচিত। আশা করি বাদীপক্ষের আইনজীবীর মাথায় এ বিষয়টি কাজ করবে।

আরো কিছু বিষয় চাইলে এই মামলায় বিবেচ্য বিষয় হিসেবে আসতে পারে। যেমন- বনানী থানার ওসির সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টায় কার কার কী কী কথা হয়েছিল? তার ফোন লিস্ট চেক করা হবে কি না; রেজিস্ট্রার খাতায় এন্ট্রি ছাড়া থাকতে দেয়ার অপরাধে রেইনট্রি হোটেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না; যে অস্ত্র অপরাধীরা ব্যবহার করেছিল তা হাতে ছিল নাকি ফ্রন্টডেস্ক- এ জমা ছিল, সেই অস্ত্র বৈধ নাকি অবৈধ; মদ আর ইয়াবার উৎস রেইনট্রি হোটেলই ছিল কি না; ঐ সময়ে হোটেলে দায়িত্ব পালনকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি না; ঘটনার পর অপরাধীদের পারস্পরিক ফোনালাপ চেক করা হবে কি না; অপরাধীকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করার অপরাধে প্রধান আসামির পিতা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদকে আইনের আওতায় আনা হবে কি না।

শেষে এই মেয়েদের বলি, আপনাদের অভিনন্দন। যে সাহস আর দৃঢ়চেতা মনে আপনারা অন্যায়ের বিচার চেয়েছেন এবং জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার প্রত্যয় থেকে পিছু হটছেন না- তা এই বাংলাদেশের সাধু পুরুষীয় যুগে নিতান্তই বিরল। অভিনন্দন আপনাদের বাবা-মা ভাইবোনদেরও। আমরা জানি, তাদের সমর্থন না পেলে এই সাহস করতে পারতেন না। আশা করি আপনাদের এই লড়াইয়ে জয় আসবেই। না আসলেও বড় ক্ষতি নেই। কারণ, আপনারা বাংলাদেশের অগুনতি নারীকে এই শিক্ষা দিয়েছেন - নারীর গায়ে যে হাত দেয়, সে-ই অপরাধী; নারী নয়। আর দশটা অপরাধের মতোই এটা একটা অপরাধ, এর বিচার আপনি চাইতেই পারেন এবং চাইতে হবে। এতে কোন লজ্জা নেই।  

লেখক: সাংবাদিক।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ মে ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়